জরিপ থেকে বয়ান: বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রান্তিক জাতি সত্তার মানুষের ভূমি সমস্যা কেন্দ্রিক সমীক্ষা ও বয়ান
রবীন্দ্রনাথ সরেন, আহমেদ বোরহান ও মাহমুদুল সুমন
প্রকাশনা: সংবেদ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০১৪
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৯৬
সায়েমা খাতুন
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রান্তিক জাতিসত্তার মানুষদের প্রতিকারহীন ভূমি বেদখল হওয়া ও ভূমি থেকে উৎখাত হওয়া দশকের পর দশক নৈমিত্তিকভাবে চলমান। ক্রমাগতভাবে ভূমি হারিয়ে ভূমিহীন দিনমজুরে পরিণত হওয়া তাদের জীবনের প্রান্তিক অবস্থার একটি কেন্দ্রীয় জায়গা। ভূমিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন জনগোষ্ঠির এই প্রান্তিকমানুষদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উৎপাদিত হয়ে চলেছে। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন রকম সাংবাদিকতাধর্মী অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ পেলেও এ বিষয়ে অনুসন্ধানী গবেষণা বিরল। পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সংঘাত, সহিংসতা, অস্ত্রের উপস্থিতি ও প্রতিরোধের তীব্রতার কারণে সেখানকার ভূমি-দখলের ইস্যু গণমাধ্যমে উত্তপ্ত আলোচনার বিষয় হলেও বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের বহুজনগোষ্ঠির ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাগুলো দলিলকরণ হয়নি বললেই চলে।
বাংলাদেশের জাতীয় আদিবাসী পরিষদ আরো কিছুসংগঠন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে এ রকম কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে যাতে ভূমি-হারানোর বিষয়গুলো সুনির্দিষ্টভাবে নথিবদ্ধ করা যায়। পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নওগাঁ জেলার কৃষি ও ভূমির উপর নির্ভরশীল পাহাড়ি, মুন্ডা, সাঁওতাল, ওঁরাও, পাহান জনগোষ্ঠিদের ভূমিসমস্যার নানা দিক নিয়ে কাজ করবার চেষ্টা করে আসছে। এরা সুনির্দিষ্টভাবে কতখানি জমি হারিয়েছে, কী প্রক্রিয়ায় এই বেদখলের ঘটনা গুলো ঘটেছে, তার একটি তথ্যভান্ডার গড়ে তোলার কাজ করে যাচ্ছে এই পরিষদ। ২০০০-২০০১ সালে আদিবাসীদের ভূমি সমস্যা বিষয়ক একটি কর্মশালা থেকে ভূক্তভোগিদের জীবনে মামলা-মোকাদ্দমা, বাস্তুচ্যুতিসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করবার প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণকরে। এরই ফলে দলিল-দস্তাবেজহাতে প্রতিকারের আশায় আসা নিপীড়িত মানুষের বয়ান লিপিবদ্ধ করারসূত্রপাত। ২০০৮ সালে ভূমিহারানোর প্রক্রিয়ার একটি জরিপ সম্পন্ন করা হয়। এ থেকে তৈরি করা তথ্য সারণী নিয়ে পরবর্তী সময়ে পাঁচটি জেলা শহরে মত বিনিময় করা হয়। এই সময়ে ভূক্তভোগিদের বয়ান রেকডর্ করা হয়। এই জরিপের সংখ্যাগত হিসেব এবং বয়ানের বিবরণী সংকলিত কওে গ্রন্থবদ্ধ করেন রবীন্দ্রনাথ সরেন, আহমেদ বোরহান ও মাহমুদুল সুমন। প্রাপ্ত তথ্য ও বয়ানকে কেবল উপস্থাপন করাটার কাজটাকেই এই প্রকাশনার কাজ বলে স্থির করেন এই গবেষকেরা। বিশ্লেষণের কাজটি ভবিষ্যতের লেখার জন্য। অথচ কেবল তথ্য উপস্থাপন থেকেই ১৯৪৭ এর দেশভাগ পরবর্তী উত্তর-উপনিবেশিক পাকিস্তান ও ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশ জমানার বাঙালি মুসলমান ভিন্ন অপরাপর জাতি গোষ্ঠির সকলেরই প্রান্তিক পরিচিতি নির্মাণের রাজনীতিতে ভূমি ইস্যু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৭১-৮০ এর মধ্যে ‘ভেস্টেড প্রপার্টি’ আইনের ব্যবহারে বা অপব্যবহারে বাঙালি মুসলমান প্রিভিলেজড এবং ভূমির উপর অধিকারে অধিপতি অবস্থান নিতে সক্ষম হয়। রাষ্ট্রযন্ত্র বাঙালির আধিপত্যেও সহায়কশক্তি হিসেবে কাজ করে। পাকিস্তানই কেবল নয়, বাংলাদেশও শেষ অবধি স্পষ্টত সকলের দেশ না হয়ে বাঙালি মুসলমানের রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। বহু মানুষের বিবিধরকমের ‘ঐতিহ্যবাহীভূমিব্যবস্থা’র স্বীকৃতি এতে মেলেনি,বরং জমির খোলাবাজারের পণ্য বৈশিষ্ট্য জোরদার হয়েছে।
লেখকত্রয় বলেন, “প্রকাশনাটিতে ক্লাসিক্যাল নৃবিজ্ঞানের ‘মাঠকর্মভিত্তিকউপাত্ত’র ধারণা থেকে সরে গিয়ে আমরা সাক্ষ্য বা বিবৃতিপ্রদানের দায়বদ্ধতার এমন এক পরিসরকে উন্মোচন করতে চেষ্টাকরেছি, যার সঙ্গে তুলনা চলে কেবল অ্যাক্টিভিস্ট নৃবিজ্ঞানের।” এবং এটি তাঁরা করেছেন, এ যাবৎকালে শুনে আসা রাষ্ট্রের কিংবা অধিপতি গণমাধ্যমের বড়বড় স্বরের থেকে খুবই ভিন্ন স্বরের কথনকে তুলে এনে। অশ্রুত ছোট ছোট এই স্বর শিক্ষিত ভদ্রলোকের পক্ষে খুব অচেনা দূরবর্তী এক জগত। রাষ্ট্রবাদী ইতিহাসের বিপরীতে রণজিৎ গুহ যাকে বলেছেন ইতিহাসের ছোট ছোট স্বর।
অ্যাক্টিভিস্ট নৃবিজ্ঞানের জায়গা থেকে তারা দুটি ভূমিকা রাখতে চেয়েছেন: এক. টেস্টিমনি বা প্রামাণিক সাক্ষ্য তৈরি করা। নৃবিজ্ঞানী ডিক হেবডিজের অনুসরণে নৃবিজ্ঞানের প্রথাগত এথনোগ্রাফিক বর্ণনার পরিবর্তে সাক্ষ্য-প্রমাণে ভূমিকা রাখতে চেয়েছেন। সাক্ষ্য যেখানে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বলা জীবন কথা, সাক্ষী হওয়ার মধ্য দিয়ে একটি নির্দিষ্ট অবস্থান গ্রহণ করা এবং দায়বদ্ধতার মধ্য দিয়ে নৃবিজ্ঞানের এই গবেষণা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক। নৃবিজ্ঞানের কাজের দুটি ধরন লিসা মালকির মত গ্রহণকরেন এঁরা: ইনভেস্টিগেটর ও সাক্ষী কিংবা যুগপৎ।
বয়ানসাক্ষ্য দিচ্ছে এ রকমবিষয়গুলো:
– আমরাই কৃষি কাজের জমি তৈরি করে কৃষির উৎপত্তি ঘটিয়েছি, আর আমরাই খাওয়া পাইনা।
– যুদ্ধের আগে বিহারিরা, আর যুদ্ধেও পর ফিরে এসে দেখি বাঙালিরা আমাদের জমি দখল করে নিছে, আর আমাদের তাড়াইছে।
– হড় ভাষায় ‘বার’ মানে ২, বাঙালিকে হড় বলল বার বিঘা জমি বিক্রি করব, বা বাঙালি প্রতারণা করে লিখল ‘বারো’ অর্থাৎ ১২ বিঘা।
নৃবিজ্ঞানের তত্ত্ব ও পদ্ধতি ব্যবহার করে এটি একটি ছোট্ট অথচ পথিকৃত গবেষণা। বয়ানগুলো পাঠ করতে যেয়ে আমি স্পষ্ট যে, এই কথ্য ইতিহাসের বয়ান বাংলাদেশের গ্র্যান্ড ইতিহাসের বিপরীতে যে বহু ইতিহাসের টুকরার পাহাড় রয়েছে তার অতিক্ষুদ্র কাজ এটি। হিমশৈলের তলায় লুকিয়ে আছে বৃহৎ বহু জীবনের বয়ান।
সায়েমা খাতুন: নৃবিজ্ঞান বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক।