মাহমুদুল সুমন
[কয়েক বছর আগের কথা। উত্তর বঙ্গের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি সমস্যা নিয়ে অনুষ্ঠিত একটি কর্মশালায় উপস্থিত হয়েছি রাজশাহীতে। আলোচনা শুনে মনে হচ্ছিলঃ নানা ধারার কথা; উত্তর বঙ্গের আদিবাসী হিসাবে পরিচিত জনগোষ্ঠীর ভূমি হারানোর নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার উপর, অর্থাৎ কী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষজন নিজ জমি থেকে উৎখাত হয়েছে সে নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। কেউ কেউ আবার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমির অধিকার সুরক্ষার জন্য যে আইন উপনিবেশিক সময় থেকেই আছে, তার কার্যকারিতা নিয়ে কথা তুলছিলেন বা আইনটির বাস্তবায়নে নানা সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরছিলেন; কেউ কেউ বলছিলেন উত্তর বঙ্গের আদিবাসী জনসমষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় একটি ভূমি কমিশনের কথা। আবার ঐ একই আলোচনায় কেউ মতামত দিয়েছিলেন, যৌথ-ভূমি-ব্যবস্থা রক্ষার পক্ষে। কর্মশালা চলাকালীন সময়েই আমার সাথে কথা হয়েছিল সরাসরি কয়েকজন ভুক্তভোগীর সঙ্গে, যারা ভূমিগ্রাসীদের হাতে জমি হারিয়েছেন বা নানা ধরনের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে গেছেন। আমার মনে আছে, আলোচনার মূল স্বরটা এদের অনেকেই ধরতে পারছিলেননা। জমি-জমা নিয়ে নানাভাবে নিপীড়িত কিছু মানুষের হাতে সেদিন ছিল জমির দলিল সহ নানা কাগজ পত্র। হয়তো আশা করে এসেছিলেন ভূমিবিষয়ক এই ওয়ার্কশপ থেকে কোন সুরক্ষা বা উপকার পাবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। আলোচনাটা হয়ে গিয়েছিল কিছুটা তাত্ত্বিক বা আদর্শিক ধরনের।
আজ অনেক বছর পর জাতীয় আদিবাসী পরিষদের অন্যতম সংগঠক রবীন্দ্রনাথ সরেন-এর কাছ থেকে উত্তরঙ্গের আদিবাসীদের ভূমি সমস্যার বর্তমান পরিস্থিতি ও সেক্ষেত্রে সমাধানকল্পে কী করনীয় সে বিষয়ে কিছু পদক্ষেপের কথা শুনলাম। মনে হল, পূর্বের নানা পরিসরের আলোচনা থেকে সরে এসে ভূমি ও ভূমির অধিকার প্রশ্নে অনেক সুনির্দিষ্ট হয়ে উঠছে আজকের পদক্ষেপ ও প্রস্তাবনাগুলো। কতগুলো বিষয় এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছেঃ উত্তর বঙ্গের অনেক এলাকাতেই আদিবাসীদের জমি বিনা অনুমতিতে (ষ্টেইট একুইজেশ্যান এন্ড টেনেন্সি এক্ট এর ৯৭ ধারা অনুযায়ী এডিসি ল্যান্ড এর অনুমতি স্বাপেক্ষে আদিবাসী ব্যক্তির জমি হস্তাান্তরের বাধ্যবাধকতা আছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই আইনকে এড়িয়ে জমির হস্তান্তর হয়ে থাকে ) বিক্রি হয়েছে। এটি বিদ্যমান আইন পরিপন্থী। এক্ষেত্রে অনেকের মত, সরকার চাইলেই একটি অর্ডিন্যান্সের মধ্য দিয়ে এই সকল জমি-হস্তান্তর বাতিল করতে পারে। এছাড়া রংপুর দিনাজপুর অঞ্চলের অনেক জায়গায় বনবিভাগ সামাজিক বনায়নের নামে কিছু জমি দখল করেছে। এই জমিগুলোও ফেরত চেয়ে দাবী জানাবে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ । কেননা অদিবাসীদের নামে এই জমিগুলোর রেকর্ড আছে। আরো কিছু দাবীর মধ্যে আছে আদিবাসীরা যে সব খাস জমিতে অনেক বছর ধরে বসবাস করে আসছে, সেগুলো আদিবাসীদের মাঝেই বিতরণ করা।
একটি সাক্ষাৎকারে আমরা অনেক ধরনের বক্তব্য পাই। কোন অংশে থাকে বক্তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি। কোথাও প্রকাশ পায় তাঁর পর্যবেক্ষণ। কোথাও থাকে খুব আবেগের সাথে উঠে আসা কিছু কথামালা, আশঙ্কা। সাক্ষাৎকারে তাই কখনও কখনও আবেগের কথা থাকে, থাকতে পারে। থাকে আশাবাদের কথা, স্মৃতি। এই সবকিছুই বয়ান, ইংরেজীতে ন্যারেটিভ্। সাধারণত বয়ান বলতে বোঝানো হয় এমন বক্তব্যসমষ্টি যার একটা গল্প চরিত্র আছে। তবে এর আরো নানা দিক আছে। একারণেই ন্যারেটিভ জান্রা প্রত্যয়টির প্রয়োগ দেখা যায় কোন কোন গবেষণায়। আত্মকে বুঝতে এই বয়ান জরুরী। ‘আত্ম বর্ণনা’ বলে সামাজিক গবেষণায় একটি ধারণা আছে। বয়ান রেকর্ড করা, তুলে ধরা বা সংরক্ষণ আত্ম প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ একটা উপায় হতে পারে। সমাজ গবেষণায় এটি একটি বহুল ব্যবহৃত হাতিয়ার (টুল)।]
১৯৬২ সালে রাজশাহীতে রায়ট হয়। তখন আদিবাসীরা আক্রান্ত হয়েছিল। ’৬৫ সালে অনেক আদিবাসী সমাজের জমি অর্পিত করা হয়..আর এখন কাজ নাই। মজুরী বৈষম্য আছে। …একসময় দেখা যাবে আদিবাসীরা আর এই দেশে থাকতে পারবেনা। আদিবাসীদের মধ্যে এখন আবারো দেশত্যাগী হবার সম্ভবনা আছে। আনেকেই হয়তো চলে যাবে ..হয়তো মিশে যাবে ঝারখন্ডে .. সেখানে বিশাল আদিবাসী এলাকা। বিশাল এলাকায় মিশে গেলে আর কিছু না হোক ..মনের প্রশান্তি পাবে। ঘুরতে ঘুরতে হয়তো সেটেল হয়ে যাবে একসময়।
এখানেতো [বাংলাদেশে] এখন অনেক নিপীড়ন। প্রতিনিয়ত মেয়েরা শারিরীক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে- যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে.. মাঠে কাজ করতে যেয়ে। স্থানীয় লোকজন, জোতদারদের হাতে এই নির্যাতন হচ্ছে… যেহেতু বিচার হচ্ছেনা..বিচার চেয়ে লাভ নেই জেনে অনেকে নিরবে হজম করছে সেসব…মানুষ যখন গরীব হয়ে যায় তখন তার আর কোন মূল্য থাকেনা, মূল্য থাকে?.. তখন হয় সব কিছু দিয়ে দিতে হবে অথবা যুদ্ধ করে মরে যেতে হবে অথবা..পালিয়ে বাঁচতে হবে.. তো পালানোর তো আর জায়গা নাই। ..কেননা আদিবাসীদের স্বতন্ত্র গ্রামগুলো আগে যেভাবে ছিল এখন সেভাবে দেখা যায়না। গ্রামের মধ্যে কিন্তু বাঙ্গালিরা ঢুকে পড়েছে। স্বতন্ত্র গ্রাম পাড়াগুলো কিন্তু এখন নেই। স্বতন্ত্র জীবন যাপন কিন্তু নষ্ট হয়ে গেছে। ..
প্রথম দিকে, মিশন আসলেও প্রথম দিকে একটা স্বতন্ত্র জীবন যাপন থেকেছে। প্রথমে মিশনের সাথে সংস্রব কম ছিল। সমাজচ্যুতদের প্রথমে মিশন রিক্্রট করেছে। আমি শুনেছি যাদের ডাইনী ..বলা হয়েছে ..বা যারা একগোত্রে বিয়ে করেছে, সমাজের নিয়ম ভেঙ্গেছে। এরাই প্রথম আশ্রয় নেয়।
জিতু সাঁওতালরা মিশনের ধার ধারেনাই। তবে হিন্দুরা এটাকে একটা আবরণ দিতে চেষ্টা করেছে। (আদিনা মসজিদ দখল প্রশ্নে) রঙ দিতে চেয়েছে।
প্রশ্ন: কমন প্রপার্টিবা যৌথ মালিকানাধীন সম্পদ কি উত্তর বঙ্গের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক?
উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা আমরা একথাটা বলিনাই।…আমরা বলেছি সুস্পষ্টভাবে যে যেসব জমি জাল হয়েছে, বেনামীতে দখল হয়েছে, ভুয়া দলিল হয়েছে সেগুলো বাতিলের দাবী জানিয়েছি। আর উত্তরবঙ্গে ঐরকম যৌথ মালিকানাধীন সম্পদ তো নাই। আমরা দেখি নাই। যৌথ বলতে কবরস্থান।
প্রশ্ন: কমন প্রপার্টির বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেইে আলোচিত হলেও এই বিষয়টি একেক জন এক এক ভাবে বুঝে থাকে।
তবে গ্রাম পত্তনের সময় জমিকে কেন্দ্র করেই হয়। তখন মান্ঝির নেতৃত্বেই জমির ভাগ হয়। ..সাঁওতালদের পাড়াগুলোতে মাঝখানে রাস্তা। দুই দিকে বাড়ি । এটাই ঐতিহ্য। বাড়ি গুলো যেভাবে সাজানো হয়, জমিও সেভাবে পত্তন করা হয় লাইন বরাবর। জমির রেকর্ডও হয়েছে সেভাবে।
.. পশ্চিমবঙ্গেও এমনটাই দেখা যায়। আমাদের পাড়াটাও এভাবেই ছিল। এখন ভেঙ্গে গেছে। নবাবগঞ্জে এখনও এরকম পাড়া পাওয়া যাবে। ..বনজঙ্গলের ভেতর গ্রাম পত্তনের এরকমই করা হয়েছিল। নাচ গানের সুবিধার জন্যই এটা করা হয়।
বাংলাদেশে সরকার আদিবাসীদের জন্য কিছু করছেনা। পশ্চিমবঙ্গের সরকার আদিবাসীদের জন্য দায়িত্ব নিয়েছে। সেখানে নেতৃত্বে সাঁওতাল, বর্মন, ওরাও থেকে প্রতিনিধি আছে। মন্ত্রী এমএলএ আছে। ১৯ ডিষ্ট্রিকটের মধ্যে ৫/৬ টা জেলা পরিষদে সভাপতি আদিবাসী। নেতৃত্বের বেশীরভাগ ভারতের বাম পন্থার সাথে যুক্ত। আদিবাসীরা ধর্মান্ধ দলের সাথে যুক্ত হতে চায়নি। চেষ্টা হয়েছিল। ঝাড়খন্ডের প্রথম চীফ মিনিষ্টার বিজেপির ছিল। তখন বিজেপি ক্ষমতায়। কিন্তু ধরে রাখতে পারেনি।
..বাংলাদেশে আদিবাসীদের মধ্যে অওয়ামীলিগের সমর্থন বেশী। সেটা বুঝেই হোক আর না বুঝেই হোক। বামপন্থীদের সাথেও আদিবাসীরা আছে। … ভারতে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মসূচীর মধ্যেই আদিবাসীদের প্রশ্নটা আছে। বাংলাদেশে তা দেখা যায়না।
[সাক্ষাৎকারের সময়কাল ২০/০২/০৮]