সায়েমা খাতুন
আধুনিক রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার একটি কাঠামোগত কৌশল – মৃত্যুর রাজনীতি। ইতালীয় দার্শনিক গিয়রগি আগামবেন মৃত্যুর গ্রীক দেবতা থানাটোসের নাম অনুসরণে একে নাম দিয়েছেন “থানাটোপলিটিক্স” (১৯৮৫)। নাগরিকের দেহের ওপর, জীবন-মরণের উপর আধুনিক যুক্তিশীল রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতাকে ফরাসী দার্শনিক মিশেল ফুঁকো বলেছেন জৈব-রাজনীতি। জৈব-রাজনীতি হল, অসংখ্য ও বিচিত্র কলাকৌশলে জনগণের দেহ-প্রাণ ও জনসংখ্যার ওপর আধিপত্য কায়েম করা (ফুঁকো, যৌনতার ইতিহাস, ১৯৭৬, পৃ ১৪০), যেমন রাষ্ট্র কর্তৃক জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি, টীকা নিতে বাধ্য করা, গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেয়া, জনস্বাস্থ্য বিধানে নাগরিকের দেহের ওপর বিভিন্নভাবে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করা ইত্যাদি।
এই জৈব-রাজনীতির ধারনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা কায়েম ও বিস্তারে মৃত্যুর ব্যবহারকে আগামবেন থানাটোপলিটিক্স বলেন। থানাটোপলিটিক্স এর ধারণা দিয়ে আমরা বুঝতে পারবো, কেন বাংলাদেশের মত দেশে গণহারে মৃত্যুর জবাবদিহিতা নেই? কেন প্রতিদিন অকাল মৃত্যুকে জাতীয় জীবনের অঙ্গ করে তোলা হয়েছে? কিভাবে এই নির্বিকারপনা টিকে আছে? কিভাবে জনসাধারণ নিষ্ক্রিয় ও বশ্য হয়ে পড়েছে ? আর আমরা এই ব্যাপারে কি-ই বা করতে পারি?
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জীবন নিয়ে হেলাফেলার সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে মৃত্যুর রাজনীতির খেলায়। ক্ষমতার রাজনীতি মৃত্যুকে স্বাভাবিক করে করে তুলেছে, অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাদের সংস্কৃতি হয়ে পড়েছে। ব্যক্তি হিসেবে, নাগরিক এই সংস্কৃতির শিকার হয়ে গেছে, মৃত্যুর রাজনীতির বশীভূত হয়ে পড়েছে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যু দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। আম-জনতা একদিকে রাষ্ট্রের উপর ভরসা হারিয়েছে, আবার অন্যদিকে হারিয়েছে নিজের সক্রিয় এজেন্সি। নিষ্ক্রিয়তা ও বিচ্ছিন্নতার ফাঁদে পড়ে এখন উপায়ন্তরহীনভাবে পরিত্রাণের জন্যে নিরাকার উপরওয়ালার নাম জপ করা ছাড়া আর কিছু বাকী নেই। এই ভয়, আতঙ্ক, গণমৃত্যু , মৃত্যু নিয়ে নিষ্ক্রিয়তা আধুনিক রাষ্ট্রের শাসনের অপকৌশল।
গ্রাম-নগরীতে ঘরে ঘরে মৃত্যুভয়ের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অস্বাভাবিক মৃত্যুকে আমরা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে শুরু করেছি, যেমন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে আমরা মেনে নিয়ে চলছি। বিষ মিশানো খাদ্য , ক্রসফায়ার, গুম- খুন, ধর্ষণ, পুড়িয়ে মারা, গণপিটুনিতে মারা, বন্যায় ভেসে, লঞ্চ ডুবিতে, ভিআইপিদের জনসাধারণের চলাচলের ফেরি আটকে এম্বুলেন্সে শিশুর মৃত্যু, – রোজকার জীবনে বিচিত্রভাবে জনসাধারণের মৃত্যুকে বাংলাদেশে নাগরিক জীবনের স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তোলার একটি প্রক্রিয়া চলছে অনেক দিন ধরে। অকাল অস্বাভাবিক অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর মিছিলের ভেতর জনসাধারণ সম্পূর্ণ স্বাভাবিকভাবে খেয়ে-পরে, উৎসব করে জীবন-যাপন করে যাচ্ছে । যারা বেঁচে আছে, তারা যে কোন সময় মৃত্যুর কড়া নাড়া শোনার অপেক্ষায় ভয়ে-আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। নিজের জীবনের ভয় এবং অপরের মৃত্যুকে অবজ্ঞা – হাত ধরাধরি করে দুঃশাসনের পক্ষে সম্মতি আদায় করে নিয়েছে। যারা মৃত্যুবরণ করছেন, এবং যারা বেঁচে আছেন উভয়কেই এই আতঙ্ক এবং অবজ্ঞা বিমানবিক করে তুলেছে। না আছে আমাদের মৃতের প্রতি সম্মান, না জীবনের প্রতি মর্যাদা। এই মৃত্যু নিয়ে অপদার্থ নিষ্কর্মা নিশ্চুপতা আমাদের মনুষ্যত্ব নষ্ট করে দিচ্ছে।
আমাদের প্রথমে এই মূল সামাজিক সম্মতিতে পৌঁছাতে হবে যে, প্রত্যেক জীবন অমূল্য, কেননা আমরা কেউ কখনও জীবন সৃষ্টি করতে পারবো না। প্রত্যেকটি মানুষ অপ্রতিস্থাপনযোগ্য, বিনিময়অযোগ্য সম্পদ, জাতির জন্যে স্রস্টার উপহারস্বরূপ। জীবন নিয়ে অবহেলা কেবল অনৈতিকই নয়, পরিষ্কারভাবে অপরাধমূলক আচরণ। জীবিতরা মৃতদের প্রতি দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। আমরা যারা বেঁচে আছি তারা কোন না কোনভাবে স্বজনদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায়দায়িত্ব বহন করি।
বাংলাদেশ অতিক্রম করছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ডেঙ্গুর প্রকোপ। আক্রান্তের সংখ্যা সরকারী হিসেবে ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পত্রিকায় আসা এই নির্লিপ্ত নৈরব্যাক্তিক সংখ্যাগুলো থেকে আমরা ডেঙ্গুর দ্রুত বিস্তারে মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং জীবনের নিরাপত্তা, স্বাভাবিক মৃত্যুর সম্ভাবনা হ্রাসের ফলে পরিবারগুলো কিভাবে ধ্বংস ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে তার কিছুই আন্দাজ করতে পারি না, অনুভবও করতে পারি না। হাজার হাজার রোগ-শোকগ্রস্থ, পরিবার-পরিজনের মৃত্যুশোকে মুহ্যমান, আর্থিক, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত পরিবারগুলোর ক্ষয়ক্ষতি, ভীতি, বিপন্নতা পরিমাপ করা এই মুহূর্তে অসম্ভব। যেসব বাচ্চারা, মায়েরা রাস্তায় থাকে, তাদের কি হচ্ছে, সেটা কল্পনা করবার শক্তিও খুঁজে পাই না। স্রেফ কুকুর- বেড়ালের মত রাস্তায় মরে পড়ে থাকছে কি? হাজার হাজার মানুষ এখন প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে এবং প্রতিদিন মৃত্যুর খবর দিয়ে আমাদের দিন শুরু হচ্ছে। স্বাস্থ্য দপ্তর বা নগর প্রশাসন এই পরিস্থিতির জন্যে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত ও অসংগঠিত। এডিস মশার প্রজনন ও বিস্তারের উপর কারো কোন নিয়ন্ত্রণ আছে বলে মনে হচ্ছে না। ঢাকাসহ সারা দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপে মৃত্যু ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের নিয়ে কোন জরুরী সমন্বিত কার্যকরী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দেখা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, জনস্বাস্থ্যের দেখভালের দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানের এবং ব্যাক্তিদের বিচিত্র লোকদেখানো প্রস্তুতিবিহীন আচরণ এবং কর্মকাণ্ডে জনগণ ভরসা খুঁজে পাচ্ছে না।
২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যু কোনভাবেই অবশ্যম্ভাবী নয়, যেমন ছিল আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আবিষ্কারের আগে। ডেঙ্গু কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ও নয়, এটি সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট সংকট এবং স্বাস্থ্য-প্রশাসনিক-আমালাতান্ত্রিক বিপর্যয়, ডেঙ্গু একটি সামাজিক-নৈতিক-পরিবেশ বিপর্যয়। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু জন্মেছে এবং বিস্তার লাভ করেছে নগর প্রশাসনের অব্যাবস্থাপনা ও দায়িত্বহীনতার বদ্ধ জলাশয়ে । ঢাকার মত একটি মনোরম নগরী যেটি ওস্তাদ নগর পরিকল্পকের মাষ্টার প্লান অনুসারে বিস্তৃত হওয়ার কথা ছিল, তাতে যত্রতত্র যথেচ্ছ নির্মাণ করে, পরিকল্পিত বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যাবস্থা গড়ে না তুলে, গণযোগাযোগ ব্যাবস্থা গড়ে না তুলে, সবুজ খোলা জায়গা না রেখে পৃথিবীর নিকৃষ্ট বাসযোগ্য শহরে পরিণত করা হয়েছে।ঢাকা নগরী একটি মানব-সৃষ্ট সংকট।কিন্তু এই বিপর্যয়ের জন্যে দায়ী শক্তি বিচিত্র বাগাড়ম্বরের আশ্রয়ে আত্মগোপন করে থাকছে।
আমাদের সহজ সাদামাটা প্রশ্ন হলঃ ডেঙ্গু মধ্যযুগের প্লেগের মত নিবারণ অযোগ্য কি? না। যদি তাই হয়, তাহলে মানুষ বাঁচানোর জন্যে সম্ভাব্য সব কিছু করা হয়েছে কি? না। এডিস মশা বিস্তার রোধে নগর প্রশাসন, ডেঙ্গুর চিকিৎসায় স্বাস্থ্য প্রশাসন, মন্ত্রণালয়, সম্ভাব্য সকল পদক্ষেপ নিয়েছে কি? না। এমনকি সন্তোষজনক পদক্ষেপ নিয়েছে কি? না। বরং, এই জীবন-মরণের গুরুদায়িত্বশীল পদে কর্মরত ব্যাক্তিদের অসংলগ্ন কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ড অবিশ্বাস ও অনাস্থার সৃষ্টি করেছে। নাগরিকদের জীবন–মরণের হর্তা–কর্তা হওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা, এই দায়িত্বের অপরাধমূলক অবহেলাকে তদন্তের আওতায় আনতে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক খাটনি করার দরকার।
এখনও যারা বেঁচে রয়েছি, মৃতদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব হল এই অপরাধগুলোকে উন্মোচন করা।এটা কেবলমাত্র কোন ব্যাক্তি বিশেষের ব্যাক্তিগত দুর্নীতি ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডমাত্র নয়। কোন এক মন্ত্রীর বদলে এর বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হবে না। এটি একটি বৃহৎ সিস্টেমের থেকে উৎপাদিত। বিশেষ করে গণহারে মৃত্যু এবং ত্রাসের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র নাগরিকদের অসম্মতির মধ্য দিয়েও ঠেলে নেয়ার বৈধতা অর্জন করে অথবা অপশাসনের পক্ষে সম্মতি সৃষ্টি করে। আইন-কানুন, প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার মধ্য দিয়ে নাগরিকের দেহকে বশ্য, অধীনস্ত করে তাদের জীবন-মরণের বৈধ মালিক বনে যায় রাষ্ট্র । কিন্তু আবার জন-প্রতিরোধ দেখা দিলে, ‘হায়াত-মউত আল্লাহ হাতে’ বলে জনরোষের মুখে পলায়নপর অবস্থান গ্রহণ করে। বেঁচে আছি বলে আমাদের এই থানাটোপলিটিক্সকে উন্মোচন করতে মগজ খাটানোর কাজ করে যেতে হবে। নিষ্কর্মা অপদার্থ নিষ্ক্রিয় পরিস্থিতি থেকে নিজেদের মুক্ত করে মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে।
সেপ্টেম্বর ৩, ২০১৯
সায়েমা খাতুন: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
থানাটোপলিটিকস: ভয় ও মৃত্যুর সংস্কৃতি এবং
হারিয়ে ফেলা মানবিকতা
– ANTHROPOLOGY JOURNAL http://shanarobola.com