মাহমুদুল সুমন
দু’বছর আগে হিজড়াদের পেশা ও জীবন নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম। আমার বলার বিষয় ছিল, রাষ্ট্রের দিক থেকে স্বীকৃতি (মূলত তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতির কথা মাথায় রেখে বলা কথাটা) হিজড়াদের জীবনে কী পরিবর্তন নিয়ে এলো? এই প্রশ্নটার একটা উত্তর পেলাম সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে যাওয়া এক অনুষ্ঠানের ভেতর। অনুষ্ঠানটি ছিল এমন: একটি বিশেষ উৎসবের দিনে হিজড়াদের একটি দল সারাদিন থাকবেন জাবি ক্যাম্পাসে। তাদের উদ্দেশ্য মেহেদী রঙে সবাইকে রাঙিয়ে দেয়া। আর এর মধ্য দিয়ে তাদের নতুন এই কাজের ক্ষেত্রটিতে বিচরণের খবর তরুণ সমাজে কাছে পৌঁছে দেয়া । উদ্যোগটার খবর আমার কাছে অভিনব লেগেছিল্। একজন ডিন এই অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেছেন, শিক্ষকরা অংশ নিয়েছেন এবং শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা চত্বরে হিজড়াদের এই উদ্যোগে সামিল হয়েছেন, ছবি তুলেছেন। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরে এরকম অনুষ্ঠান আমার মনে পড়েনা।
বাংলাদেশে হিজড়াদের আমরা সচরাচর কিছু নির্দিষ্ট পেশার ভেতরেই দেখি। এই ক্ষেত্রে হিজড়াদেরকে তাদের ‘অন্যতাকে’ পুঁজি করেই জীবিকার সন্ধান করতে হয়। এটা অনেক ক্ষত্রে আমি যে নৃবিজ্ঞান চর্চা করি, তার জন্য একটা সংকট তৈরী করে। কেননা যে নৃবিজ্ঞান আমি চর্চা করতে সচেষ্ট তার কাজই হচ্ছে ‘অন্যতা’কে পরিচিতির গন্ডীর ভেতর নিয়ে আসা এবং কখনও কখনও পরিচিতকে নতুন করে চিনবার পথ তৈরী করে দেয়া (বাংলাদেশে বসে নৃবিজ্ঞান চর্চা করতে যেয়ে এই শেষোক্ত কাজেই আমাদের সময় কাটে বেশী। কেন এরকম পরিস্থিতি হল, সেটা অবশ্য অন্য প্রসঙগ।)
বাস্তবতা এই যে দক্ষিণ এশিয়াতে হিজড়াদের এখনও তাদের ’অন্যতাকে’ পারফর্ম করেই বেচে থাকতে হয়। সেটা করলেই শহরের মানুষেরা তাদেরকে আলাদা করে বিবেচনা করে এবং সাহায্য করে। হিজড়া পরিচয়ে এভাবে যে সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, তা বহু যুগ ধরে গড়ে উঠেছে এই অঞ্চলে। এমনকি নৃবিজ্ঞানের সাহিত্যেও আশির দশকের বই পত্রে হিজড়াদের সচরাচর একটা ‘সাবকালচার’ হিসাবে বিবেচনা করবার চল ছিলো । আজকাল এসব শব্দকে আধিপত্যবাদী ও পজিটিভিস্ট বিবেচনা করে বাদ দেয়া হয়। কে কার সাব? কালচারই বা কাকে বলা হচ্ছে? আরো সব নতুন শব্দমালা দিয়ে লিঙ্গিয় পরিচয়গুলোকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। এসব চিন্তা, পদাবলী আগের যেকোন সময়ের চেয়ে দ্রুততার সাথে ছড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের এই সময়ে।
বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে হিজড়ারা একটা আলাদা কমিউনিটির বাসিন্দা হয়ে সমাজে বসবাস করে আসছে। সেই ধারার কিছু পরিবর্তন হচ্ছে কি? কেন জানি আমার মনে হয় আগের তুলনায় হিজড়া জনগোষ্ঠী ভয় দেখিয়ে, তালি বজিয়ে টাকা সংগ্রহ করে কম। কিছুটা ভিন্ন পরিসরে আমি নিজে ভারতের একটি শপিং মলে প্রথম হিজড়দের আর পাঁচজন শপ অ্যাটেনডেন্ট এর মত করে কাজ করতে দেখি খুব বেশী দিন আগে নয়। সাজ সংক্রান্ত একটা ব্র্যান্ডের দোকানে প্রথম আবিষ্কার করি পুরো দোকানটা হিজড়াদের দ্বারা পরিচালিত। এরকম চাকচিক্যময় পরিবেশে হিজড়াদের দেখা সেটা আমার প্রথম সাক্ষাৎ। করপোরেট ট্রেনিংয়ের কারণেই হয়তো তাদের খুব স্মার্টও দেখাচ্ছিল। এর থেকে অনেক বেশি হিজড়াদের সাথে আমার দেখা হয়েছে রাস্তায়। বহু বছর আগে খোলা রাস্তায় ‘বাজার তুলতে যেয়ে’ খোলাখুলি চুমু খাবার দৃশ্যটির একদিকে ছিলেন একজন হিজড়া, আরেকদিকে সব্জী দোকানদার। এরকম খোলামেলা চুমু খাবার দৃশ্য (সম ও বিষম লিঙ্গের মধ্যে) এরপর শুধু ইউরোপেই দেখেছি। এছাড়া বাচ্চা হলে হিজড়ারা গান বাজনা করতে চায়, নতুন বাবা মায়ের কাছে টাকা পয়সা দাবি করে, এগুলো আমাদের কম বেশী সবারই জানা। নগরের মধ্যবিত্ত সেই আবদারকে খুব ভালোভাবে নেয় বলে মনে হয়না। অন্তত আমার সহকর্মীদের সাথে কথা (যারা বেশীরভাগই বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক) বলে আমার সেরকমই মনে হয়েছ। উৎসবে পার্বণে টাকা তোলার রেওয়াজ সম্ভবত আজকের ঢাকা শহরের গেটেডে কমিউনিটির মাঝে আরো কঠিন হয়ে উঠছে দিনে দিনে।
এরকম একটি পরিস্থিতে সাজ ব্যাবসায় যদি হিজড়াদের একটা অংশ শ্রম দিতে পারে, আর সাধারণ মানুষ যদি এটাকে গ্রহণ করে, তবে এর থেকে ভালো খবর আর হয়না। তাই এধরনের উদ্যোগকে স্বাগত জানানো যেতে পারে। গত কয়েক বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই হিজড়াদের নিয়ে যেসব নতুন কাজ হচ্ছে, সেগুলো প্রশংসনীয়। দেশের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজড়াদের পড়াশুনার জন্য অগ্রাধিকার দেবার কথাও শুনেছিলাম। ক’জন ভর্তি হতে পারলো সেটা আর জানা হয়নি। পরে দেখলাম সেই ভিসিরই চাকরী নেই নেই অবস্থা! হিজড়াদের আর ভর্তি করতে পারলেন কিনা সন্দেহ! ট্রাফিক পুলিশের কাজে কি হিজড়াদের নেয়া হল শেষ পযর্ন্ত? প্রসঙগত বাংলাদেশে ২০১৩ সালে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং ২০১৫ সালে ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে হিজড়াদের নিয়োগ দেওয়ার সরকারী সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু এসব নীতিগত সিদ্ধান্ত থেকে কী অগ্রগতি হল তা এখনও স্পষ্ট নয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলন চেয়েছিল বাংলাদেশের তরুণ সমাজ, যা প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর ভিন্ন খাতে প্রবাহিত। কোটা প্রশ্নে নানা পর্যায়ে সরকারের অবস্থান তাহলে কী? হিজড়ারা আজও পিছিয়ে রয়েছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু কোটার সুবিধাতো তারা পেতেই পারেন।
(প্রথম আলো পত্রিকায় ভিন্ন শিরোনামে লেখাটি প্রথম ছাপা হয় ১১.০৬.১৮ তারিখে।)
মাহমুদুল সুমন, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।