সায়েমা খাতুন
ফেসবুকে সুখী সুখী সংসারের ছবির বন্যা বইতে থাকবার অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক এই সময়ে ঢাকাতে প্রতি ঘণ্টায় ডিভোর্সের খবর এসেছে। চট্টগ্রামের পরিসংখ্যানও প্রায় একই। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলো এতে বিস্ময় প্রকাশ করে সংবাদ ও পর্যালোচনা পরিবেশন করেছে। খবরটা নিঃসন্দেহে একটা নতুন সামাজিক পরিস্থিতির ইঙ্গিত করে। যারা এখনও ’অপশন’ এর অভাবে ডিভোর্স করেননি, এমন বিবাহিত ’সারভাইভার’দের সংখ্যাও নাটকীয়ভাবে বড় হবে বলে অনুমান করা যায়। জনমিতিক দিক থেকে দেখলে বিংশ শতকের সর্বশেষ প্রজন্ম হিসেবে আমরাই গণহারে পেশায় ঢুকে পড়া নারীসমাজ এবং মোটামুটি ’মিলেনিয়াল’ অর্থাৎ ২০০০ সালের পরে জন্মানো শিশুদের বাবা-মা। আমার বন্ধুদের কেউ কেউ ঠিক ২০০০ সালে প্রথম সন্তানের জন্ম দিয়েছে। এ বছর তারা প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক হলো। আমাদের প্রজন্মোর বেশিরভাগের সন্তান জন্মেছে শূন্য দশকে। আমি যখন বিলম্বিত বিয়ে করতে যাচ্ছিলাম, আমার অনেক বন্ধুরা তখন বহুদূর এগিয়ে ছিল, তারা দ্বিতীয় বিবাহ করছে। আমাদের বাবা-মায়ের প্রজন্মে ডিভোর্স, পুনর্বিবাহ ছিল খুবই বিরল এবং ছিল খুবই নেতিবাচক। এই নিয়ে প্রায় সে-সময় একটা কেলেঙ্কারির মতো করে কানাঘুষা করা হতো। এই পরিসংখ্যানে এমনটা বলা হয়েছে যে, ডিভোর্সকে নেতিবাচক হিসেবে দেখার কিছু নেই। বহু নারী পারিবারিক সহিংসতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ায় উপায় খুঁজে পেয়েছে। অসুখী দাম্পত্যের ভেতর মানুষের সৃষ্টিশক্তি ব্যাহত হয় এবং সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো হয় না। একটা সর্বশেষ উপায় হিসেবে ডিভোর্সকে আমাদের মেনে নিতেই হয়।
বড় ধরনের সামাজিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত
পশ্চিমের সমাজে তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে গেছে পরিবার। পরিসংখ্যান অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৫০% বিয়ে ডিভোর্সে গড়ায়। ’সিঙ্গেল প্যারেন্টে’র পরিবারে বড় হচ্ছে বিরাট বড় সংখ্যক বাচ্চারা। সাবেক প্রেসিডেন্ট বরাক ওবামার মতো পশ্চিমের বহু কৃতি ব্যক্তিত্ব বড় হয়েছে ’সিঙ্গেল মাদারে’র পরিবারে, আরও স্পষ্ট করে বললে, প্রধানত একা মায়ের সাথে। গবেষণার অভাবে আামাদের দেশে সিঙ্গেল প্যারেন্ট বা একক মা-একক বাবার সাথে বড় হওয়া বাচ্চাদের পরিবার-ঘরগৃহস্থালী সম্পর্কে তেমন কোন স্বচ্ছ ধারনা পাওয়া কঠিন। পশ্চিমা বহু রাষ্ট্রে সামাজিক নিরাপত্তার দায়িত্ব কমবেশি রাষ্ট্র বহন করে। অথচ আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তার মুখ্য প্রতিষ্ঠান পরিবার এবং সামাজিক সুরক্ষায় রাষ্ট্র প্রায় অনুপস্থিত। পশ্চিমের কল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলো সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধা বা ’সোশ্যাল সিকিউরিটি বেনিফিটে’র বাতাবরণে নাগরিকদের অসঙ্গতি ও অসমর্থতার সময়, যেমন – চিকিৎসা, বেকারত্ব, মাতৃত্বকালীন, শিশুযত্ন, বার্ধক্য শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা, গৃহহীনতা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রয়োজনে বেঁচে থাকার নুন্যতম এক ধরণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, যে নিশ্চয়তা আমাদের রাষ্ট্র প্রদান করে না। আত্মীয়তার সম্পর্ক ও পরিবারই আমাদের সমাজের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার পাটাতন। পশ্চিমের সমাজ ’সিরিয়াল মনোগ্যামি’ আদর্শের। এক স্বামী-স্ত্রীর সংসার ভেঙ্গে আবার নতুন করে এক স্বামী-স্ত্রীর সংসার গড়ে ওঠে, আবার ভাঙ্গে। বিয়েবিহীনভাবেও নারী-পুরুষের সংসার গড়ে আর ভাঙে। ভালোবাসার জন্যে বিয়ের এই ধারণা খুব শক্তভাবে সমাজের প্রোথিত। বিয়ের ভেতর ভালোবাসা ফুরিয়ে গেলে কিম্বা বনিবনা না হলে, সম্পর্ক টেনে বেড়ানোর চেয়ে এরা বিচ্ছেদ বাঞ্ছনীয় মনে করে। ভালোবাসা ফুরিয়ে যায়ও সহজেই। আমেরিকায় একজন নিজের পরিচয় দেয় ‘হ্যাপিলি ডিভোর্সড’ হিসাবে (যধঢ়ঢ়রষু ফরাড়ৎপবফ), অর্থাৎ সম্পর্কচ্ছিন্ন সুখী। এখানে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের গুরুত্ব এক নম্বর। ব্যক্তির বিকাশের স্বার্থই চূড়ান্ত। এমনকি পরিবারগুলোকেও এক একটা ব্যক্তির মতো মনে হয়। সমাজের বাঁধুনি একেবারেই অন্যরকম। বাংলাদেশে সমাজে আমাদের যে মাখামাখি, অন্তরঙ্গ আবেগ-অনুভূতির অন্তহীন প্রবাহ সেটা পশ্চিমা সমাজে ব্যক্তির আয়-রোজগার, সাফল্য, ক্যালেন্ডার, ডেডলাইন, আর কাজের ঘণ্টার হিসেবে প্রযুক্তির নির্ভরতায় এমন এক চেহারা নেয় যে, এর তুলনা করা অসম্ভব।
আবার, পশ্চিমের সমাজ সম্পর্কে অবাধ যৌনাচারের যে দেশি মিথ বাস্তবে এত সহজ কিন্তু বিষয়টা নয়। ছোটবেলা থেকেই বাচ্চারা স্কুলে ছেলে-মেয়ে আলাদা সামাজিক সার্কেল গড়ে তোলে। মেয়েরা ছেলেদের সাথে একসাথে খেলাধুলা করে না। বয়েস হলে যেটা করে, সেটা ডেটিং, প্রেমের সূচনা বা বিয়ের সম্ভাবনা যাচাই বলা যেতে পারে। যৌনতা এবং এর ‘কন্সেকোয়েন্স’ বা পরিণাম সব সমাজেই ভয়ের চোখে দেখা হয়, পশ্চিমেও বিষয়টি এর বাইরে নয়। যেখানে-সেখানে ‘যা খুশি তা’ করাকে এখানে “trashy” অর্থাৎ জঞ্জাল বা আবর্জনার সামিল বলে মনে করে। আমেরিকার ‘‘hook up culture” নিয়ে অনেক বাবা-মায়েরাই দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে, কিন্তু আবার সন্তানদের পছন্দের স্বাধীনতাকে অনুমোদন করে। ”হুক আপ কালচার” হলো নারী-পুরুষ সম্পর্কের একটা ধরণ যেখানে কোন অঙ্গীকার ছাড়াই ক্ষণস্থায়ী, এমন কি এক রাতের যৌন সম্পর্কের চর্চাও প্রচলিত। এতে সামাজিক বা আবেগীয় বন্ধনের চেয়ে শারীরিক অভিজ্ঞতাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। প্রেম, পরিবার, সংসারের সবার উপরে সত্য ঘন্টা ধরা কর্ম-নীতিনৈতিকতা ও সংস্কৃতি। আমার মতে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিষয় হলো এই যে, মার্কিন চাকরির বাজারের যখন তখন ‘‘hiring and firing” সংস্কৃতি পরিবারগুলোকে স্থিরভাবে বসতেই দেয় না। এই অতিউত্তর-পুঁজিবাদী এই সংস্কৃতিতে চাকুরীর বাজার সব সময় অস্থির, যে কোন সময় যে কাউকে বিনা নোটিশে সকাল বেলায় বরখাস্ত করা যায় এবং প্রতি মুহুর্তে এই ঘটনা ঘটতে পারে। মানুষজনকে এক শহর থেকে আরেক শহরে কেবল ঘুরে বেড়াতে হয়। লোকে বাড়ি কেনে আর বেচে। স্থায়ী বন্ধুত্ব গড়ে ওঠাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। পরিবারগুলো সারাক্ষণ দৌড়ের ওপর এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় কাজের জন্য যাবার “moving ” এর সম্ভাবনার মধ্যে কোথাও ভালোভাবে শেকড় গাড়তে পারে না। একটা বড় দাবির মতো শোনালেও, সামাজিক অভিজ্ঞতায় এটি ‘নরমাল’।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক কারণে এখানে স্থিরভাবে বিবাহিত পারিবারিক জীবন-যাপন করতে পারাটাই বেশ একটা সাফল্যের মতো। সিঙ্গেল মাদার পপুলেশন পশ্চিমের জন্যে একটা বড় ধরনের সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এই পপুলেশন সবচাইতে গরিবদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান। অপেক্ষাকৃত নতুন দেশি-আমেরিকান (ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত) সমাজ এখনও এক বিবাহকেন্দ্রিক পরিবারের আদর্শ ধরে আছে, যদিও বিশ্বায়নের গতির সাথে সাথে সবথানেই ডিভোর্স জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। ডিভোর্সের কারণ এবং একে কেন্দ্র করে সমাজতাত্তি¡ক, মনস্ততাত্তি¡ক গবেষণার কোনো শেষ নেই। আগ্রহী পাাঠকের জন্যে এই লেখার নিচে সেরকম কিছু গবেষণার তালিকা দেয়া আছে। বাংলাদেশ ডিভোর্স অপেক্ষাকৃত নতুন সামাজিক অভিজ্ঞতা। দেশে ডিভোর্স প্রসঙ্গে দুটো কথা খুব জনপ্রিয়। এক. পশ্চিমা ভাবধারার আমদানি, দুই. মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়া ও নারীবাদের উত্থান। গবেষকদের ভাষায় নিও-লিবারেল অর্থনীতি এবং পশ্চিমা আদর্শের বিশ্বায়নের পরিণাম এবং মেয়েদের রোজগার করতে ঘরের বাইরে আসার ওপর অনেকে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে চান। সত্যি কথা বলতে কি, ভালো গবেষণার ভিত্তি ছাড়া এ নিয়ে কোনো আলাপ গভীর করা যায় না। তাই সেখান থেকে কোনো সিদ্ধান্তে আসা মুশকিল। এমন একটি গবেষণায় এখনই হাত দেয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু আপাতত, একটি গুরুতর সামাজিক পরিবর্তনের মুখে দাঁড়িয়ে সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে সাধারণ কিছু পর্যবেক্ষণ ও আলাপ তো আসতেই পারে।
পিতৃতান্ত্রিক পরিবারের ভাঙ্গন
পরিবারের ফ্রন্টে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই মোটামুটি আশির দশক থেকে বাংলাদেশের মেয়েরা হরে-দরে কারখানায় ও বেতন-ভিত্তিক পেশায় ঢুকে পড়েছে। অত্যন্ত অপরিণামদর্শী রাষ্ট্র, কর্পোরেট, কিম্বা কমিউনিটি কেউই এই নিয়ে তলিয়ে দেখেনি, কিম্বা সময়ও পায়নি। গোটা ব্যাপারটা মেয়েদের ব্যক্তিগত দুশ্চিন্তা বলে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু এই ব্যক্তিগত বিষয় সম্পূর্ণ রাজনৈতিক “personal is totally political”। শ্রমিক ও শিক্ষিত কর্মজীবী নারী-সকলের জন্যেই শিশু লালন-পালনের, কিম্বা বৃদ্ধ শ্বশুর-শ্বাশুড়ির, কিম্বা অসুস্থ পরিজনের দেখভাল করা, যাকে বলে ‘কেয়ার ওয়ার্ক’, এর জন্যে যখন-তখন বাড়িতে থেকে যাওয়ার উপায় নেই। ফুলটাইম চাকরী করে ফুলটাইম ঘর-সংসারের দায়িত্ব পালনের অবকাশ কোথায়? কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলোÑএই কাজগুলোর দায়-দায়িত্ব একেবারে একান্তভাবে মেয়েদের জন্যেই রয়ে গেছে। এমনকি সমাজ আগে যে দায়িত্বগুলো পালন করতো, সেও পিছু হঠেছে। যৌথ সম্প্রদায়ের মূল্যবোধ ভেঙ্গে পড়ে পরিবারগুলো একা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আন্তঃপরিবার সহযোগিতা ক্ষীণ হয়ে পড়েছে। পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব নিয়ে বিবাহিত কর্মজীবী নারীর পরিবারে টেনশন, লাঞ্ছনা-গঞ্জনার নতুন পর্ব শুরু হয়েছে। এ সময়ে পারিবারিক সহিংসতার একটি বড় প্রণোদনা হলো পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক ক্ষমতা-কাঠামো এবং এর সহায়ক চর্চাগুলো : স্বামী ও তার পরিবারের নারীদের কাছ থেকে ঘর-গেরস্থালীর অতিরিক্ত কাজ ও বিচিত্র ধরনের সেবা ফ্রি আদায় করবার জন্যে চাপ সৃষ্টি করা, যৌতুকের বিকল্প হিসেবে নারীদের রোজগারে বাধ্য করা এবং আয়-রোজগারে কর্তৃত্ব করা, আবার সন্তানের দিবা-যতেœর দায়িত্ব অস্বীকার করা। এই অবস্থায় নিও-লিবারেল অর্থনীতিতে পরিবারগুলো পুঁজিবাদী পুরুষের মুনাফা ও স্বার্থকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ক্রমশ সহিংসতার বিকাশ ঘটিয়েছে এবং জঘন্যরকমভাবে বি-মানবিক হয়ে পড়েছে। পরিবারে দুর্বলের উপর সহিংসতা তীব্র হয়েছে। কিছু সৌভাগ্যবান ব্যতিক্রম বাদে বেশির ভাগ বিবাহিত নারীদের স্বামীর পরিবারের নারীরা পিতৃতান্তিৃক ক্ষমতার প্রধান প্রয়োগকারী; যেমন স্বামীর মা, বোন, খালা, নানী, মামীরা পুরুষের চাইতে বেশি দক্ষতার সাথে ”খোঁটা”, শারীরিক-মানসিক শোষণ-পীড়ন করে বিবাহিত নারীকে অধস্তন করে রাখতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
এই পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক মূল্যবোধ আত্মবিরোধী, নারী-বিদ্বেষী এবং পুরুষের পরিবারের আধিপত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। ’মায়ের মর্যাদা’ একটা বুজরুকি ধারনা। এই মর্যাদা কেবল প্রাপ্তবয়স্ক ছেলের মায়ের। মেয়ের মায়ের (এবং বাবার) অমর্যাদার কোনো সীমা নেই। নাবালক ছেলের মায়ের দশাও তথৈবচ। নারীর মর্যাদা বলতে বোঝায় প্রধানত প্রৌঢ়/বৃদ্ধ মায়েদের ’কম্পেন্সেশন’; যেটা হরহামেশা আদায় করা হয়, তরুণী পুত্রবধূর/শিশু সন্তানের মায়ের শোষণমূলক সার্ভিসের মাধ্যমে। ’রিটায়ার্ড’ ’মায়ের আত্মত্যাগ’-এর দাম আদায় করা হয় নতুন মায়েদের লাঞ্ছনা-গঞ্জনার এবং নির্ঘুম বিশ্রামহীন জবরদস্তিমূলক ’ফ্রি’ শ্রম আদায়ের মাধ্যমে। তরুণী, ’একটিভ’ মা অর্থাৎ ছোট বাচ্চাদের মায়েদের প্রতি এই ধরনের পরিবার ভীষণ রুঢ় ও নির্দয়। গর্ভবতী ও নবজাতক শিশুর মায়ের শরীর-স্বাস্থ্য, দেহ-মনের অবহেলা গরিবদের মধ্যে তো বটেই, স্বচ্ছলদের মধ্যেও চূড়ান্ত রকম। শিশু লালন-পালনের সকল দুশ্চিন্তা মায়েদের কাঁধে রেখে বাচ্চাদের প্রতিটা ভুল নিয়ে তরুণী মায়েদের হেনস্থার কোনো শেষ নেই। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের প্রৌঢ়/বৃদ্ধ মা পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে অক্লান্তভাবে ছোট ছোট বাচ্চাদের মায়েদের চুড়ান্ত হয়রান-পেরেশান করতে থাকে। আজকের প্রবাদ “স্বামীর ঘরই নারীর আসল ঘর”, কালকে বচনে দাঁড়ায়, “বউ বদলান যায়, মা বদলান যায় না”তে। নিমিষে সেই তথাকথিত ‘আসল ঘর’ থেকে নারীকে যখন তখন উৎখাত করতে কেউ পিছ-পা হয় না। এই বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে এমনকি নারীবাদীরাও ঝেড়ে কথা বলে নাই। যখন-তখন ডিভোর্সের কিম্বা অন্য যে কোন হাতিয়ার ব্যবহার করে মা ও শিশুকে ‘dump’ ও ‘abandon’, অর্থাৎ দায়িত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পরিত্যাগ করার ক্ষমতা রাখে পুরুষের পরিবার। কেবল পুরুষই তাঁর কপর্দকহীন স্ত্রীকে সন্তানসমেত পরিত্যাগ করতে পারে, শুধু তাই নয়। তার মা, বোন, বাবা, ভাই এর অসীম ক্ষমতা যখন যার ইচ্ছা হবে, তখনই সে ‘ডিভোর্স দেওয়া’তে পারে। নারী ও শিশুকে রাস্তায় ছুঁড়ে দিতে এদের যে কারো এক মুহুর্তেও মেজাজ খারাপ হওয়াই যথেষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্যে, যেমন উইস্কন্সিনে, এ কারণেই বিয়ের আইন অনুযায়ী, কোনো বিবাহিত নারীকে কোনো অজুহাতেই ঘর থেকে ‘kick out’ করা বা রাস্তায় ছুঁড়ে দেয়া যায় না। নারী ও শিশু ঘরে থাকবে এবং মতের অমিল হলে পুরুষ ঘর ছাড়বে।কিন্তু তাই বলে, ভরণপোষণের দায়িত্ব এড়াতে পারে না। আমাদের মায়েদের প্রজন্মে ফুল-টাইম সংসার করে যেতে হয়েছে, অন্তত চাকরি করতে হয়নি। নিজের রোজগারও ছিল না, রোজগার করে কাউকে খাওয়ানোর দায়িত্বও তাদের ছিল না। কিন্তু পরিবারের দেখভালের কাজ বা ’কেয়ার-ওয়ার্ক’ সব আমলের সমাজের জন্যেই আবশ্যিক। এখন এর দায়িত্ব পুনর্বণ্টনের করবার সময় এসেছে।
নিম্ন আয়ের গরীব পরিবারগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ডিভোর্সের ধার ধারে না। সংসারের রোজগারের ভার পুরুষ অনেক ক্ষেত্রেই নারীকেও বহন করতে হয়। উচ্চ বা মধ্যবিত্ত গৃহিণীর জীবনের মত কেবল গৃহবাসী জীবনের বিলাসিতা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এমন কোন নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন যে, গরীব পরিবারের বিচ্ছেদ ও ভাঙনের কোন স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। ডিভোর্সেও চেয়ে এখানে স্বামী স্ত্রী-সন্তানের আর্থিক ও অন্যান্য দায়িত্ব স্রেফ অবহেলা করে অথবা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে। গরীব নারীর পক্ষে যেমন কোর্ট-কাছারি করা সম্ভব হয় না, তেমনি গরীব পুরুষও মধ্যবিত্ত পুরুষের আদর্শে পরিবারকে খাওয়া-পরানোর মত দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করতে পারে না। ভূমিহীন জনখাটা পুরুষ-নারীর পরিবার, বিচ্ছেদ, ভাঙন নিয়ে জরীপ, গবেষণা খুব ভিন্ন রকম চিত্র নিয়ে আসবে বলে অনুমান করা যায়।
যে মানব সম্পদ অর্থনীতির চালিকা শক্তি, সেই মানুষ জন্মানো ও লালনপালনের হেড কোয়ার্টার হলো পরিবার। রাষ্ট্র এবং কর্পোরেট মানুষের কর্ম-শক্তিকে ব্যবহার করছে, কিন্তু এই কর্মশক্তি যেখানে জন্ম ও প্রতিপালন করা হচ্ছে, তাকে ছেড়ে দিয়েছে ব্যক্তিগত দায়িত্ব হিসেবে। বৃদ্ধ, রোগী, অ-সমর্থ, শিশু সকলের দেখভালের সব ভার পরিবারের কাঁধে চাপিয়েছে, যেখানে পরিবার ভেঙ্গে ভেঙ্গে অণু-পরমানুতে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। বিবাহিত কর্মজীবী ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা নারী কিংবা শ্রমিক-কৃষক নারীর কাঁধেই বিনা বেতনের সব সামাজিক কাজের দায় এসে বর্তেছে, যেখানে সম্প্রদায় দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। আফ্রিকান প্রবাদে বাচ্চা বড় করতে যেখানে আস্ত এক গ্রামের কথা বলা হয়েছে, সেখানে অণু-পরিবারে বাচ্চা একা মায়ের দায়দায়িত্বে দাঁড়িয়েছে। ফলে, সন্তানের মা হওয়ার সাথে সাথে নারীর যেখানে ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পাকাপোক্ত হওয়ার কথা, সেখানে মাতৃত্ব একটা নিঃসঙ্গ বিষন্নতায় নারীর অগ্রগতির পথে বাধার মতো ভারি হয়ে পড়েছে। আনন্দের ধারা বিষাদের নদীতে এসে নেমেছে। পরিবার শিশুদের অভয়ারণ্য না হয়ে বন্দীশালায় পরিণত হয়েছে। নগরের ফ্ল্যাট বাড়িতে কিম্বা মফস্বলের নতুন বহুতল আবাসনে শিশু-কিশোরদেরদের খেলা বন্ধ করে দিয়ে আমরা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে যাচ্ছি। শিশু-কিশোরদের বন্ধুত্ব ও সামাজিক জীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছি। শ্রমিক পরিবারগুলোর শিশুরা সবচাইতে অরক্ষিত অবস্থায় জীবন-যাপন করছে।
বিয়ে একটা আঁটসাট দম-আটকানো কারাগারের রূপ নিচ্ছে আর তাতে নারী ও পুরুষ ক্রীতদাসের মতো জীবন টেনে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পুঁজিবাদ এবং পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধে প্রতিষ্ঠিত এই পরিবারের জন্যে রোজগার এবং গৃহকর্মের পরস্পরবিরোধী দায়িত্বের ভারে কর্মজীবী নারীর ’স্ট্রেস’ অকল্পনীয়। পরিবার অকার্যকর ও ব্যর্থ হয়ে পড়ে আমাদের সামাজিক জীবনকে ব্যর্থ করে দিয়েছে। এই পরিবারের ভাঙ্গন অবশ্যম্ভাবী।
আমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলেছিলাম
আমি যেটা গভীরভাবে ভাবি, তা হলো যে ধরনের পরিবারই হোক না কেন, তা মানুষের সামাজিক জীবনে টিকে থাকবার একটা যৌথ প্রতিষ্ঠান। পরিবার আমাদের সন্তানদের স্বপ্ন দেখা ও আকাশে ওড়া শেখানোর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ব্যর্থ বিপ্লবের বোঝা পরিবারগুলোই বহন করে। প্রগতির ‘ব্যাকল্যাশ’ও পরিবারের পিঠে এসে পড়ে। পিতৃতন্ত্র চুলায় যাক, কিন্তু পরিবার কখনও নয়। আমাদের ঘর দুর্গ হয়ে থাকুক। উপনিবেশিক শক্তির প্রতিরোধে, আধিপত্যবিরোধী লড়াইয়ে শত শত বছর বাংলাদেশে ঘরে ঘরে দুর্গ ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল, যার সংগঠক ও পরিচালক ছিলেন নারীরা। সংগঠনের ছত্রভঙ্গ মানুষগুলোর শেষ আশ্রয় পরিবার। ব্যক্তির বিকাশেও পরিবারের আশ্রয় প্রয়োজন। বিশেষ করে শিশুদের জন্যে পরিবারের কোনো বিকল্প পাওয়া যায়নি। সন্তানের জন্যে একটি সুস্থ আনন্দময় পারিবারিক জীবন গড়ে তুলতে আমরা সব কিছু করে যাচ্ছি। কিন্তু, যেহেতু সকলের বিকাশের স্বার্থ রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই পুঁজিবাদী পরিবারগুলো গড়ে উঠতে পারেনি, ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে পড়েছে এর শক্তি। পিতৃতন্ত্রের আদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত বিয়ে ও পরিবার যা নতুন বাস্তবতায় প্রতিমুহূর্তে চ্যালেঞ্জের মুখে। নতুন ধরনের পরিবার এখন সমাগত।
নারীপুরুষের সমতা অর্জনে খরগোশ-কচ্ছপের দৌড় প্রতিযোগিতার কোনো প্রয়োজন নেই। এই প্রতিযোগিতার গোড়ায়-গলদ। পার্থক্য নিয়েই সমতা অর্থবহ। হরমোনের পার্থক্য, শারীরিক-মানসিক লক্ষ্যের পার্থক্য, কামনা-বাসনার পার্থক্য নিয়েই সমতা ও মর্যাদা অর্থবহ। নিও-লিবারেল নারীবাদের বাজার ব্যাবস্থার অধীন যান্ত্রিক সমতা একটা মায়াজাল মাত্র। তাতে বেটি ফ্রিডানের ১৯৫০ দশকের পুঁজিবাদী পরিবারের শিক্ষিত গৃহিণী যেমন অসুখী-অতৃপ্ত, ২০১৮-এর বৈশ্বিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সফল কর্মজীবী মেয়েরাও দিশেহারা (পঞ্চাশের দশকের প্রভাবশালী মার্কিন নারীবাদী বেটি ফ্রিডান উচ্চ-শিক্ষিত নারীদের গৃহকেন্দ্রিক অতৃপ্ত জীবনকে প্রকাশ্য করেছিলেন এবং কেরিয়ার-কেন্দ্রিক রোজগারের স্বাধীনতার ওপর জোর দিয়েছিলেন)। মিলেনিয়ালের কর্মজীবী, বিবাহিত, সন্তানের মায়েরা ”ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালেন্স” ধাঁধায় বিদীর্ণ।
পশ্চিমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ভুল-ভ্রান্তি থেকে আমরা শিক্ষা নিতে পারি। পুঁজিবাদী অণু-পরমানু পরিবারগুলো বড়বেশি যৌনসম্পর্কভিত্তিক। অথচ সিমেন্টের মতো অযৌন স্নেহ-মায়া, ভালবাসা, করুণা, দয়া-দাক্ষিণ্য, বন্ধুত্ব, মৈত্রীর চর্চা সামাজিক জীবনের বন্ধনকে দৃঢ় করে, নিরাপত্তা ও পূর্ণতা দান করে। এইসব সাপোর্ট সিস্টেম বিলুপ্ত করে বিয়ের ওপর অত্যাধিক চাপে তা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। যৌনসম্পর্ক সমাজের কেন্দ্রীয় সম্পর্ক হলেও, কেন্দ্রের চেয়ে পরিধির বিস্তার অনেক বড়। বিয়ের উপর অত্যাধিক ভরসা না করে, স্বামী বা স্ত্রীকে পরস্পরের জীবনের সর্ব সুখের জন্যে ভারাক্রান্ত না করে বিবাহ-বহির্ভূত বৃহত্তর পরিধির সম্পর্কগুলোকে জল-হাওয়া দিলে দুজনেই বাঁচে। ‘আমি-তুমি’, ‘তুমি-আমি’ মার্কা প্রেম ও বিয়ে দম আটকানো, সমাজ-বিচ্ছিন্ন এবং একঘেঁয়ে। এইসব আমি-তুমির অহং ছেড়ে সম্পর্কের দিগন্ত প্রসারিত করে বন্ধুত্ব, সখ্যতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী, পাড়াতুতো, গ্রামতুতো বহু বিচিত্র মানবিক সম্পর্কগুলো শক্তিশালী হতে পারে। মহল্লার সাথে, গ্রামের সাথে, দেশের সাথে, প্রকৃতির সাথে, বিশ্বব্রহ্মান্ডের সাথে, দেহ-মনের সাথে আমাদের সম্পর্ক পুনরাবিষ্কারের সময় এসেছে। প্রেম কেবল যৌনতার ভেতর নয়, বিচিত্রভাবে, সৃষ্টির প্রতি, প্রকৃতির প্রতি, পশুপাখির প্রতি, গ্রামের প্রতি, পাড়ার জন্যে, বন্ধুর প্রতি, ছোটবেলার প্রতি, জীবনের প্রতি, ইতিহাসের প্রতি, সাহিত্য ও শিল্পের প্রতি অনুরাগে সৌর পরিবারে সহ¯্র পুষ্পে বিকশিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে।
ডিভোর্স স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে যৌক্তিক ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইনিভাবে ছিন্ন করে নারী-পুরুষকে সম্পর্কের বোঝা থেকে মুক্ত করে। এই দিক থেকে ডিভোর্স মুক্তি দায়ী এক ব্যবস্থা এবং বিয়ের মতই মঙ্গলজনক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সন্তানের বাবা আর মায়ের সম্পর্ক কোনো ডিভোর্সেই নাকচ হতে পারে না। প্রাক্তন স্বামী বা স্ত্রীর সাথে শত্রতার সম্পর্ক বা পারস্পরিক চরিত্রহনন না করে সমঝোতা করাই পরিপক্কতার ও শুভবুদ্ধিও লক্ষণ। দায়িত্বশীল পিতামাতার মতো আচরণ ডিভোর্সকে ইতিবাচক সম্পর্কে পরিণত করতে পারে। সন্তানের পরীক্ষা, অসুস্থতা, জন্মদিন, গ্রাজুয়েশন, বিয়েসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে প্রাক্তন স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক মর্যাদায় পিতামাতার শক্তিশালী ভূমিকা সন্তানদের সামনে রোল মডেল হতে পারে। তাদের সামনে পারস্পরিক ভিন্নতার সাথে পারস্পরিক মর্যাদার ও সহিষ্ণুতার সংস্কৃতি সৃষ্টি করা যায়। পরস্পরের শ্বাসরোধ না করে মিলন ও বিচ্ছেদকে দিন ও রাতের মত স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় বলে স্বীকার কওে নিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে যেতে হবে।
বিকশিত বৃহৎ সম্পর্ক এবং ভবিষ্যতের কল্যানকর পরিবার
বিপুল আবিষ্কারের এই যুগে আমরা সৃষ্টিশীল আনন্দময় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কিছু এখনও আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি-না বিয়ে, না বিয়ে-বিহীন বিকল্প কোনো সংগঠন। নিজের জালে নিজেই বন্দী হয়েছি। চূড়ান্ত ব্যক্তিগত রোজগার, সঞ্চয়, ভোগ চরম আত্মকেন্দ্রিক সমাজ তৈরি করেছে। আমি ভালো থাকবো, আমার পরিবার ভালো থাকবে, আমি আর আমার পরিবার উন্নতি করবে, এই ভয়ঙ্কর স্বার্থপর সমাজ থেকে এর বেশি কিছু আশা করা যায় না। আমি, আমার পরিবারের কল্যাণ মানব পরিবারের কল্যাণের সাথে গাঁথা আছে। ভবিষ্যতের পরিবারকে আমরা কেমন করে গড়ে তুলবো সেই নিয়ে অনেক আলাপ, সাহিত্য, শিল্প, রাজনীতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। জাতি যেমন কল্পিত সম্প্রদায়, পরিবারকেও তেমনি আমরা নতুন যৌথ-কল্পনায় গড়ে নিতে পারি।
প্রথমেই পশ্চিমের অনুপরিবারের আদর্শে ’কেবল স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে গড়ে ওঠা আদর্শ সুখী পরিবার’ এর উপনিবেশিক মিথ্যা ছবিটি আমাদের মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। সুখী পারিবারিক স্টিরিওটিপিক্যাল ম্যাগাজিনের মত সাজানো ছবির লোভ ছাড়তে হবে। পরিবার বিভিন্ন কারণে বাস্তবে এই আদর্শ প্রটোটাইপে থাকে না। প্রাক-ব্রিটিশ, ব্রিটিশ ভারতে, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিচিত্র ধরনের পরিবার ছিল, এখনও আছে। জীবনচক্রের বিভিন্ন পর্বগুলো একটা বাঁধা ছকে সবসময় ঘটে না। সাময়িক বা স্থায়ী বিচ্ছেদ, ভিন্ন জেলায় বা বিদেশে চাকরী, অভিবাসন, জন-মৃত্যু, সন্তানহীনতা, দত্তক গ্রহণ, কারাবন্দীত্ব, পূনর্বাসন কেন্দ্রে যাওয়ার মত বিষয়গুলো বহমান নদীর মত পরিবারের গঠনকে সারাক্ষণ বদলে দিতে থাকে। রক্ত সম্পর্কীয় হোক অথবা পাতানো সম্পর্ক, পরিবারের অর্ন্তভূক্ত হতে পারে বিচিত্র সম্পর্কের মানুষজন। কাউকে বাদ দিয়ে সুখী হওয়ার ধারনা ভুল, সবাইকে নিয়েই সুখ-শান্তি-কল্যান। মুলনীতি হবে: কেউ বাদ যাবে না, পরিত্যাক্ত হবে না। বহুবিচিত্র পরিবার সামাজিক স্বীকৃত ’নর্ম’ এ অন্তুর্ভূক্ত হতে পারে। ’স্বামী-স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে গড়ে ওঠা আদর্শ সুখী অনু পরিবার’ গড়ে উঠেছিল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সাথে সংগতিপূর্ণ বাজার অর্থনীতির বিকাশের সাথে সাথে। পরিবারের এই মডেল বাজারের স্বার্থ উপযোগী, মানবিক স্বার্থ এর সাথে পুরোপুরি খাপ খায় না। মানব বির্বতনের ১০ লক্ষ বছর মানুষের বিচিত্র রকমের পরিবার গড়ে উঠেছিল। ভবিষ্যতের পরিবারকে আমরা কল্পনা করতে পারি রূপবৈচিত্রময়ভাবে। মানুষের পারিবারিক-সামাজিক সুখ-শান্তি-কল্যানের বিচিত্র বহুরকম রাস্তা উন্মুক্ত করে দিতে হবে। সুখী, সফল, সার্থক, চরিতার্থ হওয়ার অসংখ্য উপায় বিয়ে করে-না করে, বিচ্ছেদ করে-না করে থাকতে পারে এবং আছে। কথিত আছে যে, গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস তরুনদের বিয়ে করবার উপদেশ দিতেন এই বলে যে, বিয়ে করে সফল হলে তুমি সুখী হবে, আর না হলে তুমি দার্শনিক হবে। কোনটাই মন্দ নয়। আত্মবিকাশ আমাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য, সর্বোচ্চ সুখ হলো ভালবাসা – প্রেম, বিয়ে, পরিবার তার ভেলা মাত্র।
নারীকে অধস্তন রেখে পরিবারের প্রচলিত মডেল বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। পুরুষের প্রভুত্ব জারী রাখা পরিবার অচিরেই সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে পড়তে যাচ্ছে। এই সন্ধিক্ষণে আমাদের সবাইকে পরিষ্কারভাবে এই উপলব্ধিতে উপনীত হতে হবে যে, নারীর সংসার কেবল তার স্বামী আর সন্তান নয়, নারী এই বিশ্বসংসারের সক্রিয় কর্তাসত্তা। জগতের সৃষ্টি, পালন-পোষণ-ধারণে নারী সক্রিয় অমোঘ শক্তি। নারী পরিবারের ফাউন্ডেশন। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের সকল ভালোমন্দে বুদ্ধি, শক্তি, সৃষ্টিশীলতায় নারী সবলে ভাগ নিয়ে যাবে। নিউক্লিয়ার নিরস্ত্রীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন, কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, সা¤্রাজ্যবাদী মার্কিন পররাষ্ট্র নীতি, মহাকাশ গবেষণার বাজেট, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে নিরাপত্তা, খনিজ সম্পদের ব্যবস্থাপনা, ভোটের রাজনীতিÑএই সবই এখনকার ’মিলেনিয়াল’ মেয়েদের আলোচ্য ইস্যু। ভবিষ্যতেও পরিবারের সাথে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণ চিন্তা করে স্বাধীন বিবেকবুদ্ধি অনুযায়ী তারা কর্ম পরিকল্পনা করবে। ভবিষ্যতের পরিবারেও নারী-পুরুষ সকলের চিন্তা ও বিবেকের স্বাতন্ত্র্য রাষ্ট্রের মতো পরিবারের অভ্যন্তরেও স্বীকৃত হতে হবে। শিশুদের তাজা চিন্তা ও অসীম কল্পনাশক্তিকে আমাদের গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করতে হবে। যুব-কিশোরদের দেশ, সমাজ ও পরিবারের বিকাশে কাজ করতে দিতে হবে। তাহলে তারা দায়িত্বশীল হবে এবং এক বৃহৎ জীবনে সামিল হতে পারবার আনন্দ খুঁজে পাবে। মৌলিক মানবিক স্বার্থগুলোর অগ্রাধিকারের উপর গড়ে উঠবে পরিবার; পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য, কর্পোরেটের মুনাফা আর রাষ্ট্রের গভার্নেন্সের স্বার্থে নয়। নারী, না পুরুষের প্রাইভেট প্রপার্টি, না তার প্রাইভেট প্রপার্টির পাহারাদার, বরং বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন সৃষ্টিশীল কর্তাসত্তা। স্বামী-সন্তান-আর শ্বশুর-শ্বাশুড়ির ’আনপেইড কেয়ার-ওয়ার্ক’ মজুরীবিহীন সেবা বোঝার মত কেবল নারীর কাঁধে চাপিয়ে দেয়া হলো যৌথ দায়িত্বে ফাঁকি দেয়া। এই কাজ আসলে কোন বোঝাই নয়, যখন যৌথশ্রমে করা হয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি একে বোঝা করে নারীর কাঁধে চাপিয়ে চোখ বন্ধ করে দিয়েছে। এই ’কেয়ার-ওয়ার্ক’ এ পরিবারের প্রত্যেক সুস্থ-সবল সদস্যকে অংশগ্রহণ করতে হবে। বৃদ্ধ পিতামাতা, অসুস্থ ভাই-বোন, আত্মীয়ের দেখভাল করা পুরো কমিউনিটির দায়িত্ব, নারী-পুরুষ সকল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের সমান দায়িত্ব, কেবল স্ত্রীর একার দায়িত্ব নয়। নারীর দায়িত্ব কেবল তার স্বামী-সন্তান আর স্বামীর পরিবারের সদস্যরা নয়। প্রাপ্তবয়স্ক নারী তার নিজের পিতামাতার দেখভালেরও সমান অধিকারী। নারীর বাবা-মা ভাইবোনের প্রতিও পরিবারগুলোকে একভাবে দায়িত্বশীল থাকতে হবে। না হলে পিতা-মাতার পুত্রাকাঙ্খা কন্যাশিশুর জীবনকে বিপদগ্রস্থ করে যাবে। স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের বৃদ্ধ, নির্ভরশীল বাবা-মা ভাই-বোনের দায়িত্ব পারিবারিকভাবে যৌথভাবে গ্রহণ করতে হবে। রোমান্সে বিয়ের সূত্রপাত হলেও পরিবারকে আরও বৃহৎভাবে অনেক বাস্তব চাহিদা মেটানোর উপযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রস্তুত করতে হবে। পরিবারে ভেতরে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বেকার, প্রতিবন্ধী, দুর্বলকে গাল-মন্দ, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, ভয়ভীতি দেখানো, আগ্রাসী আচরণ বন্ধ করতে হবে। যে কারো উপরই গায়ের জোর খাটান, গালমন্দ করা, শারীরিক ও মানসিক আঘাত করা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। ভাষার শালীনতা বিকশিত রাষ্ট্র ও পরিবারের জন্যে অপরিহার্য।
শিশু-কিশোর-তরুণদের নিজস্ব প্রতিভার বিকাশের, আনন্দময় শিক্ষার পথ করে দিতে হবে। কেবল পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুত না করে ভবিষ্যতের নাগরিকদের জীবনের পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুত করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক কর্মকাÐে গোঁড়া থেকে দায়িত্ব নেয়ার প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কেবল কেরিয়ারের জন্যে নয়, চাকরির জন্যে নয়, তাদের তৈরি করতে হবে সমাজের অমূল্য সম্পদ হিসেবে। পরিবারের প্রতি রাষ্ট্রের সুরক্ষার সাথে সাথে পরিবারের বর্ধিত শাখাপ্রশাখার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, জ্ঞাতিসম্পর্কের জালের ভেতর আন্তসহযোগিতা শক্তিশালী করতে হবে, কিন্তু আবার সেটা আমলাতান্ত্রিক পক্ষপাত নয়। নারীদের সাথে পুরুষদেরও এগিয়ে নিলে সাংস্কৃতিক রূপান্তর ঘটানো যাবে। অগ্রসর নারীদের পাশে অগ্রসর পুরুষ সৃষ্টি হতে হবে। নারীর রোজগার করুক অথবা নাই করুক, পরিবারেরর আয় ও সম্পদে তার পূর্ণ কর্তৃত্ব ও অধিকার থাকবে।
পুরুষও রোজগারচ্যুত হয়ে পড়লে তার সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকতে হবে। ছোট বাচ্চা আর তার লালন-পালনকারী মায়ের স্বার্থ পরিবারের কেন্দ্রে থাকবে। শিশু সন্তানের লালন-পালনে মা পরিস্থিতি বিবেচনায় ঘরে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই মৌল পরিবারের জীবন-যাপন করবার সংস্থানের দায়িত্ব পুরুষ, বৃহত্তর পরিবার এবং রাষ্ট্র সম্মিলিতভাবে গ্রহণ করবে। পারিবারিক এমারজেন্সিকে রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিকভাবে আমলে নিতে হবে। অর্থনীতিতে এই স্বার্থ স্বীকৃত ও প্রতিফলিত হবে। কেবল মাতৃত্বকালীন নয়, পারিবারিক ছুটি বা ’কেয়ার লিভ’ এর প্রবর্তন করতে হবে, যাতে মা-বাবা, সন্তান ও পরিবারের অসুস্থ মানুষের দেখাশোনার জন্যে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার পথ প্রশস্ত হয়। শিশু সন্তানের মায়ের কাজে যোগ দেয়া এবং না দেয়ার ’চয়েস’ থাকবে। পরিবার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সূতিকাগার হবে ও নির্ভয় সম্মতির চর্চার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হবে। সমাজে বয়োজ্যেষ্ঠের মর্যাদা যেমন কল্যাণকর, তেমনি স্বৈরতান্ত্রিক মুরুব্বিতন্ত্র কারো জন্যই কল্যাণকর নয়।
এই সবকিছু আইনের মাধ্যমে হবার নয়, সাংস্কৃতিক চৈতন্যের রূপান্তরের শক্তি সুগভীর। এর সব চাইতে শক্তিশালী ক্ষেত্র হলো ভাষা ও সাহিত্য, আমাদের বিকশিত প্রেমের নতুন গল্প লেখার সময় হয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক ”ভোকাবিউলারি”র বাইরে নয়া পরিবার সম্পর্কের পত্তন হবে ভাষা-সাহিত্য ও প্রতিদিনের অনুশীলনে। আমাদের অর্থনৈতিক পুঁজির সাথে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজির বিকাশে নিয়োজিত হতে হবে। পরিবারকে রূপান্তরিত হবে ভেতর থেকে। তখন, বিবাহ-বিচ্ছেদ জীবনের একটি পর্বের স্বাস্থ্যকর অবসান এবং নতুন পথের যাত্রা বলে গণ্য হতে পারবে। বিচ্ছেদের পরে নারী বা পুরুষ, শিশু বা বৃদ্ধরা, কেউই নিরাশ্রয় হবে না। বিয়ে-বিচ্ছেদ হলেও নির্ভরশীল সন্তানের এবং পরিবারের অপরাপর নির্ভরশীলদের প্রতি দায়িত্ব এড়ানো যাবে না। শিশু ও নারীকে জীবনযাপনের উপায়বিহীনভাবে পরিত্যাগ করা যাবে না। বৃদ্ধ, অসুস্থ,অ-সমর্থ্যরে দায়িত্ব পরিবার, সমাজ, কর্পোরেট ও রাষ্ট্রকে ভাগ করে নিতে হবে। কর্পোরেট যে মানবশক্তির ব্যবহারে মুনাফা করে, তাদের পুনরুৎপাদনে তাকে ”সাপোর্ট” যোগাতে হবে। বিভিন্ন শক্তিশালী সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে হবে, যাতে বিয়ে মানুষকে বন্দী না করে, অথবা বিচ্ছেদ মানুষকে নিরাশ্রয় না করে। বিয়ে যেন এক অপশনবিহীন মানুষের টিকে থাকবার একমাত্র ভেলা না হয়।
একে অপরের জীবনে পরিপূর্ণভাবে অংশগ্রহন না করে এক সার্থক আনন্দময় সামাজিক-পারিবারিক-রাষ্ট্রীয় জীবন কী সৃষ্টি করা সম্ভব?
তথ্য সহায়িকা ও পাঠসূত্র:
Cause of increasing divorce rate in the context of world and Bagladesh. https://www.academia.edu/13667272/Causes_of_increasing_divorce_rate_In_the_context_of_World_and_Bangladesh?auto=download
Getting Out of the house, Why Bangladesh’s divorce rate is rising? Feb 28, 2019. https://www.economist.com/asia/2019/03/02/why-bangladeshs-divorce-rate-is-rising
Hasan, N., Marital separation among some poor Bangladeshi women: Analysis of some cases. European Psychiatry, 41(sS), 2017. p.S903.
Hossain, Mansura & Ghose, Sujan. One Divorse per hour in Dhaka.August 28, 2018. https://en.prothomalo.com/bangladesh/news/182345/One-divorce-in-Dhaka-every-hour
Irani, Bilkis.Divorce rising in Dhaka as women seek way out of troubled marraiges, May 14, 2017. https://www.dhakatribune.com/bangladesh/dhaka/2017/05/14/divorce-rising-dhaka-women/
Jesmin, S. & Salway, S., 2000. Marriage among the urban poor of Dhaka: instability and uncertainty. Journal of International Development, 12(5), pp.689–705.
Khan, L.T., 2004. Marital instability in Dhaka, Bangladesh with special reference to dual-earner couples. Retrieved March, 15, p.2004. https://www.lib.uchicago.edu/e/su/southasia/TESTold/Lubna.html
Maksuda Akter & Roquia Begum. Factors for Divorce of Women Undergoing Divorce in Bangladesh, Journal of Divorce & Remarriage, 53:8, 639-651, 2012. DOI: 10.1080/10502556.2012.725364
Nowshin, Nahela. Understanding the Rise of Divorce in Bangladesh.September 3, 2018. https://www.thedailystar.net/news/opinion/perspective/understanding-the-rise-divorce-bangladesh-1628311
NTV.Bangladesh: Divorse Rate Going up Alarmingly. August 2011.
Parveen, Shahnaz.Why women are driving divorce in Bangladesh’s capital? January 4, 2017. https://www.bbc.com/news/av/world-asia-38462956/why-women-are-driving-divorce-in-bangladesh-s-capital
Rangpur-Dinajpur Rural Service, 1990. Why marriages break up : a study on divorce in rural Bangladesh., Dhaka]: Rangpur Dinajpur Rural Service, LWF/World Service, Bangladesh.
Sarker, S., 2004. Bangladesh: Life After Divorce. Women’s Feature Service, p.N/A.
Yenor, Scott. October 12, 2018. https://www.heritage.org/gender/report/betty-friedan-and-the-birth-modern-feminism
লেখক: সায়েমা খাতুন, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। গ্রাজুয়েট স্টুডেন্ট, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, উইস্কন্সিন বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র। ২৯ অক্টোবর ২০১৮, পরিমার্জিত: মার্চ ১৪-এপ্রিল ৯, ২০১৯।
[এই প্রবন্ধটি মুক্তস্বর পত্রিকার চতুর্থ সংখ্যায় (২০১৯) প্রথম ছাপা হয়]