ফাহিমা আল ফারাবী

২০১৯ এর একাধিক বিপর্যয় পর্বের পর (আমাজনে আগুন, অস্ট্রেলিয়ার বুশফায়ার) ২০২০ খোদ মানবজাতির জন্যই বয়ে আনলো মহাবিপর্যয়। প্রকৃতির নির্মম পরিহাস কিনা জানি না, তবে ফুসফুসখাদক কোভিড-১৯ এর প্রকোপ দেখে মনে পড়ে যে আমাজন অরণ্যে ব্যাপক আকারে অগ্নিকান্ডের ধারাবাহিকতাকে অনেকেই ‘পৃথিবীর ফুসফুসে’ আগুন লাগার সামিল বলে মনে করেছিলেন (আমিও এমন বয়ান অবলম্বনকারি পোস্টই দিয়েছিলাম সামাজিক মাধ্যমে যদ্দুর মনে পরে)। পৃথিবীর মানবসৃষ্ট পরিবর্তনের যুগ, তথা ‘এন্থ্রোপোসিনে’* এমন পরিহাসের বাস্তবিক ভিত্তি আছে বলা যায় বোধয়!

বাংলাদেশে মার্চে প্রবেশ করে করোনাভাইরাস যেমন বাংলাদেশীদের অনেক কিছু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, তেমনি ২০০ এর বেশি দেশে যেখানেই তার পদার্পণ ঘটেছে, সেখানেই হাতছানি দিয়ে এনেছে সে এক অবাক মন্থরতা। মানুষের যে সবচেয়ে বড় শক্তি, সেই সামাজিক অস্তিত্বেই বাধ সেধেছে সে। খেলার মোক্ষম দান! মানুষকে পরস্পরের থেকে সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে সবাইকে কি পরিপাটি করেই না বুঝিয়ে দিচ্ছে নতুন করে জীবনের মর্ম।

আজ ১৮ দিন ধরে গৃহবন্দি আছি আমরা বাংলাদেশে। সত্যি বলতে ঢাকায়, ঢাকার বাইরে এই বাস্তবতা বিভিন্ন জায়গায় আলাদা ছিল। সারা পৃথিবীর সাথে আজ আমরা যেখানে একাত্ব তা হল বন্দিত্ব আর মারির প্রকোপে ও মৃত্যুতে। সঙ্গনিরোধের ব্যাপারে অনেকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন যে বিষয়ে তা হল- যাদের ‘গৃহ’ই নেই তাদের ক্ষেত্রে গৃহবন্দিত্ব কিভাবে কাজ করবে? আসলে, সংকট কালে সবকিছুর আসল চিত্র ফাঁস হয়ে যায়। ‘সামাজিক দূরত্ব রক্ষা’ যা এই ছোয়াচে রোগের সংক্রমণের প্রতিরোধকারী কৌশল হিসেবে বিশ্বব্যাপি কার্যকর করা হয়েছে, তা ভাসমান মানুষদের জন্য তাহলে নয়, কারণ তাদের তো সঙ্গনিরোধে থাকার মতন আপন আশ্রয়ই নাই। বৃহত্তর ব্যবস্থাপনা ও সংকট নিরসনের কার্যাবলির মধ্যে তাই দারিদ্রের বিবেচনার ছায়া পরে কমই, ‘ত্রাণ’ ও ‘স্বাস্থ্যসুরক্ষা’র নানাবিধ সামগ্রি বন্টনের মধ্যেই যা থাকে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ ও ভারতের প্রেক্ষাপটে অন্তত তাই দেখা যায়।

 

ডালগোনা কফি, হাসপাতাল আর ঢাকার শ্রমিক

 

করোনাভাইরাসের মোকাবেলায় আমরা অসমতা তৈরি করলেও করোনাভাইরাস কিন্তু অসম আচরণ করে না। মানে আপনি ভেবে খুশি হইতে পারেন যে এই ভাইরাসে আপনি বা রাস্তার লোকটা যেমন আক্রান্ত হইতে পারেন, তেমনি আক্রান্ত হন ব্রিটেনের প্রিন্স চার্লস, হলিউডের টম হ্যাংকস- কপাল খারাপ থাকলে মরতেও পারেন। হেন সাম্যবাদী ভাইরাসকে নিয়ে আমরা ফাপড়ে পরে যাই, কারণ আমরা আপামর জনতা আক্রান্ত হলে কোন কাগজে ত আসবেই না, আসলেও বড়জোর সংখ্যার হিসাবে- বরং চিকিৎসা না পেয়ে মরার সম্ভাবনা আছে!

অসমতা নিয়ে সত্যিই চোখ খুলে দিতে পারে একটা মহামারী, ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুইভাবেই। একই সংকটকালে আমরা মানবিক চিত্রও দেখতে পাই। মানুষের সাহায্যে মানুষের এগিয়ে আসার খবর পড়ি, কেউ কেউ নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টাও করি আর্থিক সাহায্য দানের। তবু অবাক লাগে মহামারীর পরিণতির আকাশ-পাতাল তফাত দেখে। চাকরি বাঁচানোর জন্য, জীবন বাঁচানোর জন্য যখন শত শত কিলোমিটার পথ পারি দিয়ে ঢাকা পৌছে গার্মেন্টসের শ্রমিক কাজ শুরু হবার আগের ক’টা দিন কিভাবে পার করবে সেই চিন্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন, তখন দেখি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে একটা কফি-ড্রিংক- ডালগোনা কফি। কতটা নিরাপত্তায় থাকলে ‘ট্রেন্ডি’ হয়ে উঠতে চাইতে পারি আমরা, সেই প্রশ্ন জাগে মনে।

তবে অবশ্যই এসব প্রশ্ন কটু শোনায়, বিশেষ করে সবাই যখন আমরা কম-বেশি মৃত্যুভয়ে আছি। মৃত্যুভয় এই মুহুর্তে আমাদের যেমন শারিরীকভাবে দূরে ঠেলে দেয়, তেমনি ‘কমন এনিমি’ সূত্রে আমরা আবার একত্রিত হই এক ‘যুদ্ধে’। বলছি যে, করোনা মোকাবেলায় প্রায় সময়ে একে ‘যুদ্ধে’র সাথে তুলনা করা হয় রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক নানা বয়ানে। সকলেই অবশ্য একভাবে চিন্তা করেন না, যেমন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ সময়েও বাজার-ভিত্তিক চিন্তা থেকে নড়তে পারেন না। তিনি একাধিক উৎস থেকে করোনার প্রতিষেধকের স্বত্ব কেনার চেষ্টা করেন যা শুধু আমেরিকার নাগরিকেরা ব্যবহার করবেন, এবং ব্যর্থ হন। যা হোক, রেটোরিক বা বাতচিতের দিক থেকে হলেও আমরা করোনার বিরুদ্ধে যে ‘যুদ্ধে’ অবতীর্ণ হই তাতে একাত্বতা প্রকাশ করি জাতীয়তার ভিত্তিতে, যদিও এর নিরসন হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবেই। অর্থাৎ কিনা, প্রতিষেধক আবিষ্কার, বিক্রি-বন্টন হতে হবে বাউন্ডারি পেরিয়েই। সেই অর্থনীতি এখন কট্টর জাতিয়তাবাদী নেতৃত্বের খপ্পরে না পড়লেই হয় (পড়তে পারে বলে শংকা ব্যক্ত করেছেন সমাজবিজ্ঞানী জুডিথ বাটলার)।

 

পাঠসূত্র

করোনা-কালের অসমতা চিত্র নিয়ে পড়ুন- https://www.sei.org/perspectives/covid-19-exacerbates-social-and-gender-inequalities/

জলবায়ু পরিবর্তন ও করোনা মহামারির সম্পর্কে – https://www.aljazeera.com/amp/indepth/opinion/coronavirus-outbreak-part-climate-change-emergency-200325135058077.html

বাটলারের মহামারী সংক্রান্ত আলোচনা পড়তে চাইলে- https://www.versobooks.com/blogs/4603-capitalism-has-its-limits

 

Image courtesy: author

ফাহিমা আল ফারাবী, সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

0 Shares

Leave A Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 2 =