মাহমুদুল সুমন

ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সরকারি দপ্তরগুলোতে গেলেই আমার অনেক কিছু চোখে পড়ে এবং অনেক সময় লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু লিখবো ভেবেও প্রায়ই আর লেখা হয়ে ওঠেনা। অনেক সময় মনে হয় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লিখে লাভই বা কী? কিন্তু আসলে এগুলোর একটা সামষ্টিক দিক আছে। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে আমাদের কিছু অধিকার আছে। অথচ প্রায়ই এই সরকারি দপ্তরগুলোতে গেলে আমাদের নানা রকমের বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে নাগরিকদের সেবা পাওয়ার কথা। কিন্তু কেন এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাওয়া মাত্রই আমাদের খারাপ অভিজ্ঞতা হয়? কেনই বা আমাদের মেজাজ খারাপ হয়? আমি সম্প্রতি নিজের ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য পাসপোর্ট রি-ইস্যু করতে যেয়ে হওয়া অভিজ্ঞতার কথা ভাবছিলাম। স্বাধীন দেশের নাগরিকদের জন্য পাসপোর্ট একটি গুরুত্ত¡পূর্ণ দলিল। শুনলাম মেশিন রিডেবল এর (এম আর পির) পর এখন ই-পাসপোর্ট এর যুগ আসছে! দেশের সব নাগরিকের একটি পাসপোর্ট থাকবে, এই আশা নিশ্চয়ই আমরা করবো। তো কেমন হলো আমার অভিজ্ঞতা সেটা বলি।

আমাদের কাজ মামুলিই ছিল বলা চলে। আমাদের পাসপোর্ট আছে, মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। রি-ইস্যু করতে হবে। কোন পরিবর্তন নেই। ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। জানতে পারলাম একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যারা আসতে পারবে তাদের পাসপোর্টই গ্রহণ করা হবে। কিন্তু নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন সেই সময়ের দশ মিনিট আগেই জানালো যে এরপর থেকে আর কাউকে ঢুকতে দেয়া হবেনা। কিন্ত ততক্ষণে আরো কিছু মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে। এরা সময়ের মধ্যেই এসেছে বলে নিশ্চিন্তই ছিল এতক্ষণ। হঠাৎ সময়ের আগেই আর ঢুকতে দেয়া হবে না শুনেই নানা অনুনয় করতে শুরু করলেন লাইনে দাঁড়ানো নাগরিকদের একদল। আমি তখন ভাবছি এই নাগরিকদের পয়েন্ট আছে। উনারা কীভাবেই বা জানবেন যে আজকে লোকজনের চাপ বেশী বা যেকোন কারণেই হোক নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই বন্ধ করা হবে দরজা? নানা অনুনয়-বিনয়ের পরও দায়িত্বপ্রাপ্ত এন সি ও অনড় থাকলেন। বুঝতে পাররলাম আমি সেইফ জোনে থাকলেও আমার পেছনের অনেকেরই আর আজকে আবেদন জমা দেয়া হবেনা। একটু হলে আমারও এই অবস্থা হতো ভেবেও আমি ঠিক স্বস্তি বোধ করতে পারলামনা! ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে ও ধুলা বালি খেয়ে এই মানুষগুলোর আবার আসতে হবে?

একটু পর একজন মহিলা এসে বললেন, অনেক দূর থেকে ছোট শিশু নিয়ে এসেছেন, একটু যাতে কনসিডার করে। আমি ভাবলাম এইবার যদি করে। ততক্ষণে এন সি ওর চেহারায় একটা আত্মতৃপ্তির ভাব ফুটে উঠেছে। অনেক মানুষকেই তিনি না বলে ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন। মহিলাকে একটা উঁচু জায়গা দেখিয়ে বললেন, ‘এই দিক দিয়ে যেয়ে স্যাারকে বলেন। দেখেন কিছু হয় কিনা।’ কিন্তু এত মানুষকে যে না করলেন, ফিরিয়ে দিলেন কিন্তু কথায় বা ভাবে দু:খিত হবার কোন চিহ্ন ফুটে উঠলোনা লোকটার মুখে। আমি অবাক বিস্ময়ে লাইনে দাঁড়িয়ে এসব দেখলাম!

একটা থাম প্রিন্ট এবং পাসপোর্ট স্ক্যান করে একটা রিসিপ্ট দিতে মোট তিনটি লাইনে দাঁড়াতে হল। প্রথমবার ঢুকবার লাইনটা ধরলে চারবার লাইনে। মোট সময় লাগলো চারঘন্টা। যেসব রুমে দাঁড়াতে হল সেসব রুম ধুলায় ধুসরিত। টয়লেট দূর্গন্ধময়, এমনকি কোন কোন টয়লেটে ছিটকিনি নেই। বিষয়টা অবহিত করতে যেয়ে ইউনিফর্মে থাকা অবস্থায় একজন কর্মীকে কিছু বলতে গেলে লক্ষ করলাম প্রথমে উনি নিজের স্মার্ট ফোন থেকে নজর সরাতে পারছিলেন না। আমি ‘এক্সকিউজ মি’ শব্দটা একটু চড়া গলায় উচ্চারণ করাতে আমার দিকে তাকালেন। ছিটকিনি নেই শুনে প্রথম উত্তর: এখানে আমাদের কিছু করার নাই। আমি বললাম: তাহলে কারা দায়িত্বে আছেন? একটু দেখা করিয়ে দিন বা অভিযোগ বাক্সটি কোথায় দেখিয়ে দিন। ইংরেজী শব্দের কারণেই কিনা জানিনা, ততক্ষণে আমার দিকে মনোযগ দিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে, দেখবো’। আমি তখন ভাবছি একটু আগে কেন বললেন কিছু করবার নেই! এই অব্যবস্থাপনার জন্য একটু সরিতো বলতেই পারতেন!

চারঘন্টা সময়ে দুপুরের খাবারের সময় হল। যেসব জায়গায় লাইন আছে সেসব স্থানে কোন খাবার দোকান নেই। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা কোন সময় করা হয়েছিল কিন্তু সম্ভবত মেইনটেনেন্স এর অভাবে নষ্ট পড়ে ছিল। বয়স্কদের কোন লাইন দেখতে পারলাম না। এই পুরো সময়টায় একজন ষাটোর্র্ধ্ব ভদ্রলোক তাঁর ডিফারেন্টলি এবলড সন্তানকে নিয়ে আমার সামনে থাকলো। লাইন ভেঙ্গে একটু ঘুরে এসে আবারো আমাদের সাথেই যোগ দেয়াতে জানতে চাইলাম, এলডারলি পিপলদের কোন লাইন পেলেন না? বললেন না। পরে দেখলাম সেরকম একা ইনস্ট্রাকশান আছে কিন্তু সেটা দেয়ালেই। বাস্তবায়নের জন্য যে প্রয়োজনীয় অন দ্যা স্পট গাইডেন্স দরকার তার কিছুই নেই। সেকারণে আমরা সবাই এক লাইনে!

আরো কিছু বিস্ময় তখনও আমার জন্য অপেক্ষা করছে। অবজার্ব করবার জন্য চার ঘন্টা লম্বা সময়! আমার পেছনে এক তরুণ দাঁড়িয়ে। একটু দাড়ি, বড় চুল। একজন নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার কর্মী জিজ্ঞেস করলো তুমি কি করো। তরুণ ছেলেটি প্রথমে তার প্রশ্ন বুঝতে না পেরে উত্তর দিল না। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করাতে বলল, ছাত্র। এর পরই সেই দায়িত্তে¡ থাকা ব্যক্তি বলে বসলো, ‘বাউল টাউল হবার ইচ্ছা নাইতো!’ কথাটা শুনে আমি ছেলেটির সাথে আমার বিস্ময়সূচক চাহনীটি শেয়ার করতে যাব ভেবে তাকালাম। কিন্তু তাকিয়ে মনে হল তরুণটি খুব একটা অফেনডেড হয়নি। আমি এতেও একটু অবাক হলাম। ইউনিফর্মে থাকা কারো (সে যত ছোট বা বড় পদই হোকনা কেন) কাছ থেকেও এই ধরনের মন্তব্য বড়ই বেমানান ঠেকলো আমার কাছে।

এসবই পাসপোর্ট অফিসে আমার একদিনের অভিজ্ঞতা। আমি একে কিছুতেই ভাল বলবো না। যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম মানুষকে ভীষণ স্ট্রেসড দেখাচ্ছিল। সামান্য একটা কাজে তিন চার কাউন্টার কেন ঘুরতে হবে, আমার এই মন্তব্য শুনে লাইনে থাকা এক ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘বুঝতে হবে। এটা বাংলাদেশ। এখানে অনেক নাটক!’

লাইনে থাকা অনেক মানুষকেই বলতে দেখলাম যে তারা নানা কারণে পাসপোর্ট সময় মত হাতে পায়নি বা পাচ্ছেনা। হয়তো অনেক কারণই আছে তবে সরকারী কোন দপ্তরে আমাদের কেন সবক্ষেত্রেই একটা বৈরী পরিবেশের মধ্যেই পড়তে হবে? আমরাতো পাসপোর্ট সংগ্রহ করবার মত একটি সাধারণ কাজেই গিয়েছি সেখানে? এর থেকে বেশী ল এবাইডিং কাজ আর কিইবা হতে পারে? লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা বেশীর ভাগ লোক ভীষণ বিরক্তি নিয়ে থাকলো। পর্যাপ্ত বসার জায়গা পর্যন্ত নেই। এতটা অমানবিক হবার দরকার কী? এমনকি হতে পারতো না যে মানুষজন খুব সহজ প্রক্রিয়ায়, অল্প সময়ে এবং হয়রানি ছাড়াই আনন্দের সাথে পাসপোর্টের কাজ করে বাড়ি ফিরছেন? পাসপোর্ট হাতে পেয়ে ছবি তুলছেন!

জানি এইসব ক্ষেত্রে ভি আই পি লাইন ধরা যায়। প্রায়ই দেখি লোকজন সরকারি অফিসে কোন কাজ থাকলেই পরিচিত কাউকে খুঁজে বের করে। কেন? পরিচিত লোক ছাড়া কি কোন কাজ করতে নেই? সরকারি অফিসারদের এত গর্ব করে কিসের? জনগণের ট্যাক্সেই তো সব চলে? তাহলে এই সাধারণ নাগরিকের প্রতি অবহেলাসূলভ আচরণ কেন? জবাব কী পাওয়া যাবে?

(প্রথম আলোতে প্রকাশিত, ২৯ জানুয়ারি ২০২০)

মাহমুদুল সুমন, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

0 Shares

Leave A Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

11 − 5 =