জাহিদুর রহমান
আমার নানা বাড়ীর কাছে মাদারীপুর ফেরৎ এক দম্পতির করোনা পজিটিভ পাওয়া গিয়েছে। এক মামাকে ফোন করেছিলাম এলাকার অবস্থা জানতে। মামা বলছিলেন, ‘‘কি যে একটা অবস্থা ওরে মামা । স্টান্ডের পাশে বাড়ী তাগে (তাদের) । এক ছাওয়াল, আট/নয় বছর বয়স, তারেও উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে রাখছে। মামা দুরিরতে থালে কয়ডা ভাত দেয়, কুত্তরে খাওয়ানোর মতো ,তা দেহা যায় না।” কিছু অতিরঞ্জন থাকতে পারে মামার অভিব্যাক্তিতে, তবে অনেক কিছুই হচ্ছে করোনা কালে যা আসলেই দেখা যায় না, অনেক কিছুই দেখছি যা অন্য সময় ভাবাও যায় না। যেনো করোনা ভয়ে অচেনা খোলসাবৃত আমরা, সে ভয়ের উত্তাপে বাষ্পীভূত হয়ে হারিয়ে গিয়েছে আমাদের মানবিকতা।
গত শুক্রবার নারায়নগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর বাড়ির গেইটের সামনে সাত ঘণ্টা গিটারিস্ট হিরোর লাশ পড়ে থাকলেও করোনা আতঙ্কে এগিয়ে আসেনি কেউ । শহরের দেওভোগের গিটারিস্ট হিরো ৭ এপ্রিল রাত সাড়ে ৩টায় প্রচন্ড জ্বর ও ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ওই দিন ভোরে অ্যাম্বুলেন্সে শহরের দেওভোগ এলাকার বাসা থেকে তার লাশ নেয়ার চেষ্টা করলে আশপাশের লোকজনের বাধায় হিরোকে ফেলে রেখে চলে যান অ্যাম্বুলেন্স চালক। ওই সময় পরিবারের লোকজনও করোনার ভয়ে এগিয়ে আসেননি। সাত ঘণ্টা বাসার সামনে লাশ পড়ে থাকলেও পাশে যায়নি কেউ। রাস্তায় লাশ পড়ে থাকার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। লাশ হওয়ার আগে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসাহীন মৃত্যুর কপাল আমরা দেখেছি । ঢাকার এক কবরস্থানে টাঙ্গানো করোনা রোগী দাফনের নিষেধাজ্ঞা ভাইরাল হয়েছিলো। আজ দেখলাম লাশের জানাজার জন্য গ্রামবাসীর মসজিদের চৌকি না দেওয়ার ঘটনা। এ যেনো হাচি আর কাশি দিলেই তোমার আর কেউ নেই। সে তুমি জীবিত থাকো বা মৃত হও। তুমি তখন মানুষ নও, করোনা আক্রান্ত। না চিকিৎসা বন্দোবস্ত, না সমাজ এমনকি না পরিবার, কোথাও মানবিক আশ্রয় খুঁজে পাওয়া দুরূহ একালে।
তবেকি মানবিক মন করোনা সংক্রমন বান্ধব।করোনা সংক্রমন প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা জেনেছি, করোনা উপসর্গ প্রকাশ না পেলেও একজন কোভিড ১৯ ভাইরাস ধারন করতে পারেন। এর অর্থ হচ্ছে কে করোনার ফাসিকাষ্ঠ নিয়ে জল্লাদ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা চেহারা, চালচলন এমনকি নাক, চোখ বা জিহবা দেখেও জানা যাচ্ছে না। তবে উপসর্গ প্রকাশ পাক বা না পাক, সংক্রমিত কারোর হাঁচি, কাশির কারণে শ্বাস যন্ত্র থেকে নির্গত ছোট ছোট ফোঁটাগুলির মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে প্রধানত কোভিড ১৯ ছড়ায়।। যখন কোনও ব্যক্তি কাশি করে বা হাঁচি দেয়, তখন এই ফোঁটাগুলি কাছের পৃষ্ঠেও নেমে যেতে পারে। এমনও প্রমাণ রয়েছে যে কোভিড-১৯ ভাইরাসটি পৃষ্ঠতলে – বিশেষত প্লাস্টিক বা ধাতু -তে ৩ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই তিন দিনের আয়ুতে সে হাতে, এবং নিজের হাত ধরে নিজেরই চোখ, নাক এবং মুখের মাধ্যমে ফুসফুসে পৌছাতে পারে। আর তখনই ঘটে গেলো সংক্রমন তা সে উপসর্গ নিয়ে হাজির হোক বা না হোক। সংক্রমনের ক্ষমতাবান সে হয়ে গেলো নতুন জল্লাদ। আর এই কারণেই কোভিড-১৯ এড়াতে পরামর্শ হিসাবে হাঁচি-কাশিতে টিসু-রুমাল ব্যবহার এবং জন্য সাবান দিয়ে হাত ধোওয়া, অ্যালকোহল-ভিত্তিক হাত স্যানিটাইজিং জেলগুলির ব্যবহার এর কথা প্রাথমিক সচেতনতা হিসাবে বলা হচ্ছে।এবং লক্ষণজনিত লোকদের থেকে দূরে রাখতে মনোনিবেশ করা হচ্ছে।
আমরা সবাই জানি, অদৃশ্য শত্রু সবসময় বেশী বিপদ ও ভয়ের কারণ হয়। তার পর সেই অদৃশ্য শত্রু যদি হয় প্রণঘাতি। এখন পর্যন্ত এই রোগের নিশ্চিৎ কোন পথ্য নেই, টিকা নেই যে, একটি নিয়ে নির্ভয়ে ঢং ঢং করে ঘুরে বেড়াবো। ভয় তো বাসা বাধবেই। পরিস্থিতিকে তাই ভয়ের দাবানল বলাই যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সে দাবানলে প্রান বাচলে মন বাচবেনা কেনো। মন ছাড়া প্রানের মূল্যইবা কতটুকু?
আক্রান্ত মানুষেরা মানবিকভাবে মূল্যায়িত হচ্ছেনা, নানা বাড়ীর ফোন থেকে সে ধারণা করা যায়। কিন্তু কেনো? এমন পোষাকতো আছে যা পরে আক্রান্তের কাছে যাওয়া যায়। রিস্ক গ্রুপের জন্য হোম কোয়ারেইনটাইন যেনো নির্যাতিতা নারীর সেফ কাস্টোডি। প্রথমটি রাষ্ট্রের দায়, দ্বিতীয়টি সামাজিক, মানে আমাদের। বিদেশ ফেরৎ অনেককে বাড়ীতে না পাওয়ার খবর জেনে মনে হয়েছিলো, যে সামাজিক বিড়ম্বনার কারণে আমাদের দেশে নির্যাতিতা নারী বিচার প্রার্থী হয় না, সেই কারণেই বিদেশ ফেরৎদের একাংশ পালাতক হয়, নিজ বাড়ীতে চৌদ্দ দিন হোম কোরেইনটাইন করে না। এরই ধারাবাহিকতায় লাশ রাস্তায় পড়ে থাকে , চিকিৎসা পায়না নাগরিক। এই স্বার্থপরতা কোথায় নিয়ে যাবে আমাদের?
আমি ডাক্তার নই, সংক্রমন বিশেষজ্ঞও না। আমি জানিনা কোন আয়োজনে আক্রান্তের মানুষ পরিচয় বলবৎ থাকবে। কি প্রক্রিয়ায় নিশ্চিৎ হবে চিকিৎসা অধিকার, লাশ হবেনা বেওয়ারিশ, মিলবে জানাজার খাট, কবরস্থনে দাফন। তবে জানি এই সব অত্যন্ত জরুরী। কেননা, একদিন করোনা এমন দানবরূপে থাকবে না। সেই দিন যদি মনে হয় আমাদের করোনা বিজয়ের একটি হাতিয়ার ছিলো অমানবিকতা, তবে আমরা অনেকেই অমানবিকতাকে বিজয়ের মন্ত্র হিসাবে নিশ্চিৎ রপ্ত করে নেবো।
জাহিদুর রহমান একজন কবি ও রাজনীতিবীদ।