উদ্ধব মল্লিক
আমার এক ঠাকুরদা ব্রিটিশ আমলে কুষ্ঠরোগে মারা যান। তখন কুষ্ঠ আর যক্ষা রোগ নিয়ে সারা দুনিয়ায় মানুষের ভয়ানক ভীতি ছিল। তাদেরকে বাড়ির বাইরে রাখা হতো, মাসের পর মাস বা বছর! মানুষ গোপন করত তাদের অসুখ, সামাজিকতার বিরূপ ভয়ে! মৃত্যু ভয় থেকে সামাজিক ভয়, এরপর বিচ্ছিন্নতা, এরপর ঘৃণা। তারও বহু আগে জেরুজালেম অঞ্চলে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলত। এমন ঘটনাও কম না। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তি দু একজন আত্মহত্যাও করতো! আরেকটা ছিল প্লেগ। সেখানেও ছিলো একঘরে করে রাখা, মানুষ সেই ভয়ে শহর ছেড়ে পালাতো। এই নিয়ে দাংগা পর্যন্ত হয়েছে! এত সবের পিছনে মূল  কারণ ভয়, বিচ্ছিন্নতা,সব শেষে আক্রান্ত ব্যক্তি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা।
COVID 19 এর মহামারি যখন ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লো আমরা বুঝতে শুরু করলাম কি হচ্ছে! অত্যন্ত ছোঁয়াচে এই অসুখে আতংকিত নয় এরকম কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার! কেন? ভীতি! মৃত্যু ভীতি! শুধু কি মৃত্যু ভীতি? ভীতি শুধু আর মৃত্যু তে থেমে থাকলো না, মরণের পরে কী হবে, কে করবে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি বড় প্রশ্ন এসে দাঁড়ালো। সরকারি আইনে দাফন কাফন, সেটা বেশ জটিল বিষয়! এই ভীতি কিন্তু ব্যাপক, টেলিভিশনের কল্যাণে আমরা দেখছি। বিদেশে কীভাবে ওরা সৎকার করছে, আর সুস্পষ্টভাবে প্রচার না থাকায় এতে জনমানসে আরও উৎকন্ঠা বেড়েই চললো। মৃত্যু ভীতি ছাড়া আছে আরেক ভীতি, হাসপাতালে দেখা করার সুযোগ খুব কম, এটাও এক আতংক!
এই ভীতি থেকেই তৈরি হয় সামাজিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া। এমনকি স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে বাড়ি ছাড়ার হুমকি, এলাকায় ঢুকতে না দেয়ার হুমকি,গালি-গালাজ ইত্যাদি! ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে সর্বস্তরে! সর্বস্তরে ভীতির ফল? অসুখ বা অসুস্থতা গোপন। অসুস্থতা বা exposure history থাকলে সবাই খারাপ ভাবে নিবে, তাড়িয়েও দিতে পারে, চিকিৎসা পেতে কঠিন হতে পারে, চাকুরী থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারে! সুতরাং গোপনীয়তাই একমাত্র ভাল পথ! এই ভীতি জনিত গোপনীয়তাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে চিকিৎসকদের কাছে। আচমকা চিকিৎসকেরা আক্রান্ত হচ্ছেন। তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে এসে এরাই অনেক বেশি সংক্রমণ ছড়িয়েছে ও ছড়াচ্ছে! একের পর এক সুরক্ষা প্রস্তুতিহীন ডাক্তারগন আক্রান্ত হয়ে পড়ছেন!
সরকার প্রচার মাধ্যমে বেশ ভাল কয়েকটি সতর্কবার্তা নিয়মিত প্রচার করছেন। আরও যেটা প্রচার করলে ভাল হতো, অসুখ বা অসুস্থতা গোপন করবেন না, তাতে আপনার ক্ষতি, পরিবারের ক্ষতি, দেশের ক্ষতি!
তবে শুধু প্রচার করলেই কাজ হয় না, কমিটমেন্ট বাস্তবায়ন করে দেখালে ভাল ফল আসে! মৃত্যুর পরে সৎকার সম্মানের সাথে হচ্ছে, পারিবারিক আবেগকে বিবেচনায় আনা হচ্ছে, তা কিন্তু জনমানসে পজিটিভ ফল বয়ে আনতে পারে। এরজন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষিত জনবল, যার দিকে বিশেষ গুরুত্ব এখনো হয়ত দেয়া হয়ে ওঠেনি। আর ভীতি দূর করার বা কমিয়ে আনার অন্যতম কার্যকর পথ হচ্ছে উপযুক্ত নিরাপদ হয়রানিবিহীন চিকিৎসার পরিবেশ তৈরি করা!
Image Courtesy: Author

ড. উদ্ধব মল্লিক একজন চিকিৎসক।

0 Shares

Leave A Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two + seven =