জাহিদুর রহমান
অনেক বিশেষণ পেয়েছে সে জন্মের পর থেকে। প্রথম যখন চীন দেশে তার মহা আবির্ভাব ঘটলো, ইসরাইল একে চীনের জীবানু অস্ত্রাগার থেকে অসাবধানতায় নিসৃত দাবীকরে পরোক্ষভাবে ফ্রাংকেস্টাইন হিসাবে অভিহিত করলো তাকে। আমেরিকার রাষ্ট্র প্রধানতো তাকে নিয়ে যে ধরনের বাক্যচয়ন করলেন, তাতে তাকে ’ফালতু’ ই বলা হয়েছিলো বলা যায়। বিশ্ববাসী দেখছে, ফালতু বলার খেসারত আমেরিকানদের কিভাবে হাড়ে হাড়ে দিতে হচ্ছে। আল্লাহর গজব বলতেও ছাড়েন নাই কেউ কেউ। তবে তার সাম্যবাদী চরিত্রটি বেশ নন্দিত, যদিও তার সাম্যবাদী চরিত্রের প্রভাব শ্রেনী নিরপেক্ষ নয়। সে প্রভাবে ধনীক শ্রেণী যতটা ভীত হয়েছে, ততটাই উদাসীন হয়েছে নিম্নবিত্ত । এই পরিস্থিতিকে সাম্যের বিভাজন বলা যেতে পারে। অতপর, যখন পৃথিবী জুড়ে মৃত্যুর মিছিল শুরু হলো, আতংকিত হলো সবাই। মহামারী, মহাদুর্যোগ ইত্যাদি পাঁচ তারকা বিশেষণ দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমে পড়লো এক হয়ে-বিচিছন্ন হয়ে। আমরাও আছি করোনা যুদ্ধে, আমাদেরও রয়েছে রনাঙ্গন ।
রনাঙ্গনের দিকে দৃষ্টি দেবার আগে করোনা যুদ্ধটিকে আমাদের সঠিক ভাবে বোঝা দরকার প্রথমে। বিতর্ক বিহীন ভাবে এটি একটি প্রতিরোধ যুদ্ধ, প্রতিরোধ গড়তে হবে সংক্রমণ বিস্তারের বিরুদ্ধে। যেহেতু সংক্রমিত হওয়া মানেই মৃত্যু নয়, সুতরাং চিকিৎসার ব্যাবস্থা করতে হবে আক্রান্তের। সহজ কথায়, আক্রান্তের চিকিৎসা এবং তার মাধ্যমে সংক্রমণ সম্ভাবনা বিনাশ। এই হলো করোনা প্রতিরোধ যুদ্ধের লক্ষ্য। আমাদের যুদ্ধ তাই এই লক্ষ্যে পৌছানোর যুদ্ধ। এবং যদি ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনভাবে নিজেদের কয়েক পক্ষ্য সংক্রমন দূরত্বে রাখা যায়, যদি মাস্ক পরে, বার বার হাত ধুয়ে নিজের হাতে কোভিড-১৯ সেবনের সম্ভাবনা রুদ্ধ করি, যদি ঘরে থাকি সবাই, যদি সন্দেহ বা সিমটম হলে টেস্ট প্রর্থী হই স্বপ্রনোদিত হয়ে, পজিটিভধারীরা পায় আইসোলেশন এবং চিকিৎসা তবে করোনা যুদ্ধ জয় বাস্তবিকই সময়ের ব্যাপার মাত্র। এবং যখন রাষ্ট্র জনগনকে নিয়ে তৎপর সে যুদ্ধে।
রাষ্ট্র করোনা নিয়ে তৎপর । চিকিৎসার জন্য সব উপজেলা হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ড গঠন করা হয়েছে। প্রতিরোধক পোষাক দেওয়া হয়েছে চিকিৎসা সেবার সাথে জড়িত সবাইকে। টেষ্ট করার অনেকগুলো কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। খবর রাখা হচ্ছে এলাকায় নতুন প্রবেশকারীর বৃত্তান্ত। সাধারণ ছুটির সাথে সাথে লক ডাউন করা হয়েছে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিৎ করার জন্য। নিম্নবিত্ত নাগরিকরা যাতে করে ঘরে থাকতে পারে সেজন্য বরাদ্দ করা হয়েছে খাদ্য সহায়তা। রনাঙ্গনের ফলাফল আর ভিন্নতর করে কে? পরাজয়ের কোন ফ্রন্ট রইলো কোথায়?
আসলে সততা ফ্রন্টে নির্ধারিত হবে বাংলাদেশের জয় পরাজয়। দুঃখ জনক হলেও সত্য, সে ফ্রন্টে আমরা এখনো নিরাপত্তাহীন, দৃঢ়তাহীন, প্রতিরোধহীন এবং আশাহীন। করোনা পূর্বাপর সময় থেকেই আমরা অসততা আর স্বার্থপরতায় পর্বতসম। নিজের একপয়সা লাভের লোভ অন্যের একশো টাকা ক্ষতিতে আমাদের রাখে নিরুদ্বিগ্ন দ্বিধাহীন। সততা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নিরুদ্দেশ এবং নির্বোধের অবলম্বন হিসাবে তিরস্কৃত। এমনই একটি সামাজিক প্রেক্ষাপটে করোনা মহামারীর মাতম। মহাপ্রলয় মূল্যবোধ মূল্যায়নের সুযোগ ও সম্ভাবনা তৈরী করে। দু:খজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে এখন পর্যন্ত তার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। আন্তরিকতার সততার অভাবে, করোনা চিকিৎসায় প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ডাক্তার নার্স সহ অন্যান্যদের আমরা প্রত্যয়ী মনোভাব নিয়ে করোনা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাতে পারি নাই। দুর্যোগে ব্যাবসায়ির মুনাফা লোভ আমরা থামাতে পারি নাই। মালিকের নিজ শ্রমিকের প্রতি মানবিক হবার কোন বাধ্যবাধকতা অনুভব করাতে পারি নাই। পারি নাই সততার অনুপস্থিতিতে।
তবে সবচেয়ে বড় সততার পরীক্ষা হবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিৎ করার ক্ষেত্রে। করোনা প্রতিরোধ যুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর আয়োজন হলো সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। সরল কথায় ঘরে থাকো সবাই। ঘর থাকলে ঘরে থাকতে কার না ভালোলাগে যদি, যে প্রধান কারণে ঘর থেকে বের হতে হয় মানুষের তার সমাধান থাকে। হ্যাঁ ভাত, ভাতের ব্যাবস্থা থাকলে ক্ষুধার ভয়ে বাইরে বের হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়েনা কারো। এবং সরকারী ভাষ্য মতে যথেষ্ট খাদ্য মজুদ আছে আমাদের গোডাউনগুলোতে এবং বোরো ধানের ভালো ফলন দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যথেষ্ট মজুদই কি ক্ষুধার্তের কাছে খাদ্য পৌছানোর জন্য যথেষ্ট?
প্রকৃতপক্ষে মজুদ নয়, একটি বাস্তবভিত্তিক বন্টন কাঠামো এবং জবাবদিহিমূলক ব্যাবস্থায় সে কাঠামোয় সৎ, দায়িত্বশীল ও দেশপ্রেমিক জনবল একটি দুর্যোগকালীন সময়ে প্রকৃত ক্ষুধার্তের কাছে খাদ্য পৌছানোর জন্য প্রধান শর্ত এবং সত্য হলো সেখানে আমরা এখনো কোন আশা জাগাতে পারি নাই। দশ টাকার চাল, টিসিবি’র ন্যায্য মূল্যের পন্য এবং সহায়তা কোন ক্ষেত্রেই আমরা গণস্বস্তি তৈরী করতে পারি নাই। বরং এই ধারণাই প্রকট হয়েছে যে, সাহায্য কিছু মানুষের জন্যই তা সে ক্ষুধার্ত হোক বা নাই হোক, সরকারী উদ্যোগের একটা বড় অংশ লোপাট হবে এই নিয়ম, নিজের খাদ্য নিরাপত্তা নিজেরই নিশ্চিৎ করতে হবে। শেষ উপলব্ধিতেই আর ঘরে রাখা যাবে না কাউকেই। প্রতিরোধ করা যাবেনা সংক্রমণ। একারণে সততা হয়ে দাঁড়াবে করোনা যুদ্ধে ফলাফল নির্ধারক। এখনো সময় আছে সততা ফ্রন্টকে ঢেলে সাজানোর। আমাদের মত মূল্যবোধের ঘোলা জলের দেশে কাজটি দুরহ, কিন্তু বিকল্প নেই। কেননা, করোনা যুদ্ধে সততা ফ্রন্টেই নির্ধারিত হবে আমাদের রনাঙ্গনের ফলাফল।
জাহিদুর রহমান একজন কবি ও রাজনীতিবীদ।