আতিয়া ফেরদৌসী
তাজউদ্দিন আহমদকে নিয়ে বানানো এই ডকুমেন্টারিটা দেখেছিলাম যখন আমি ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। সেই সময়ের বোধ বুদ্ধি দিয়ে তখনও ভাল লেগেছিল। তখনও একজন অসাধারণ কিন্তু ভীষণরকম সাধারণের সাথে মিশে থাকা মানুষের পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তবে, নতুন করে এটা আবার না দেখতে বসলে হয়তো বুঝতে পারতাম না আরো কত কিছুই উপলব্ধি করার আছে এর মধ্যে। এই মুহুর্তে এই ফিল্ম দেখে এত নাড়া খাওয়ার কারণ- সম্ভবত সময়টা বদলেছে। নেতৃত্বের ব্যর্থতা কি, গণতন্ত্র হারানোর সংকটটা ঠিক কোথায় কিংবা ব্যক্তিসর্বস্বতা কত উৎকট- তা এখনকার মত এত প্রকটভাবে তো বুঝিনি বারো বছর আগে! তাই তাজউদ্দিনকে এইবার আবার নতুন করে চিনলাম। রিড বিটুইন দ্যা লাইনস বলে একটা কথা আছে। এই ফিল্ম দেখতে গিয়ে সেরকম করে ঘটনাপ্রবাহ পড়লাম বলা যায়।
মুক্তিযুদ্ধের একক সংগঠকের নাম তাজউদ্দিন আহমেদ। এই কথাটা আমি পরপর দশবার বলতে চাই। বলতে চাই তাতে যদি কিছু অপরাধ কমে আমাদের। না, তাজউদ্দিন নিজের নামের প্রচার চাননি। কিন্তু আমরাও এমন বেঈমান জাতি! আমরাও তাঁর নামটা এক জেলহত্যা দিবস ছাড়া মুখেও আনিনা। যিনি ২৫ মার্চে পরিবার ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন দেশ স্বাধীন করতে, স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দিনকে চিরকুটে লিখেছিলেন- “তোমরা সাড়ে সাতকোটি মানুষের সাথে মিশে যেয়ো,” আর লিখেছিলেন যে দেখা হবে “মুক্তির পর”। এই “মুক্তির পর” কথাটায় তিনি জোর দিয়েছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, যুদ্ধটা হতে হবে। কোন আলোচনা- নেগোসিয়েশন নয়, যুদ্ধটাই হতে হবে আর তাতেই মুক্তি আসবে। অদ্ভুত ব্যাপার, অস্থায়ী সরকারের বাকী সদস্যরা সরকার গঠনের পর স্ত্রী-সন্তানের সাথেই থেকেছেন। কিন্তু তাজউদ্দিন তার জবান রেখেছিলেন। তিনি পরিবার থেকে আলাদাই থাকতেন, চব্বিশ ঘন্টা সংগঠকের দায়িত্ব মাথায় নিয়ে। এই মানুষটাকে প্রাপ্য সম্মান না দিতে পারাটা আমাদের জন্যই লজ্জার।
ডকুমেন্টারির কয়েকটা জায়গায় আমাকে পজ করে কয়েক সেকেন্ড ভাবতে হয়েছে। স্বার্থপর, নামসর্বস্ব রাজনীতি দেখে বড় হওয়া আমার কাছে অনেক কিছুই ঠিক বিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল না। কয়েকটা ঘটনা তোলা যাক! দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাজউদ্দিন ভারত বর্ডার দিয়ে দেশে ঢুকছেন। তখন বিএসএফের ডিরেক্টর জেনারেল রুস্তমজি তাজউদ্দিনকে বলেন-“We are looking forward to eternal friendship with Bangladesh.” তাজউদ্দিন কিন্তু তখন ভারতে থেকে অস্থায়ী সরকার পরিচালনা করে সদ্য ফিরে যাচ্ছেন। এক কোটি শরণার্থীকে এতদিন ভারত সরকার আশ্রয় দিয়েছে। সেই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে তাজউদ্দিনের উত্তর ছিল- “Eternal friendship AS EQUAL”। খুব ছোট অথচ কি ঋজুতা এই বাক্যের! আমরা এখন স্বাধীনতার এত বছর পরের মাটিতে দাঁড়িয়ে যা কল্পনাও করতে বুঝি সাহস পাই না!
যদিও মুক্তিযুদ্ধের পর তাঁর আদর্শ আর স্বপ্ন চুরমারই হয়েছে। তাঁর প্রিয় মুজিব ভাই স্বাধীনতার পর স্বদেশে ফিরে কোনদিন তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের খুঁটিনাটিগুলো শুনতে চাননি এই আক্ষেপ নিয়েই তাকে মরতে হয়েছে। তবে, এই মানিকজোড়ের সম্পর্ক না টেকার আফসোস তো কেবল তার একার নয়, মুজিব সপরিবারে তার খেসারত দিয়েছেন আর আমরা হয়তো এখনো দিচ্ছি।
১৯৭৩ এর ভিয়েতনাম সংহতি দিবসে ছাত্র ইউনিয়নের মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। মেয়ে সিমিন হোসেন রিমির স্মৃতি থেকে জানা যায়, এইদিন তাজউদ্দিন বলছিলেন- ‘এই দেশটাকে আর রক্ষা করা যাবেনা”। তাজউদ্দিন ঠিকভাবে জানতেন, আসলে কোন জায়গাটায় পচন ধরলে দেশটাকে রক্ষা করা যায়না। অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তিনি দলের এই আদর্শচ্যুতিতে ভেঙ্গে পড়েছেন। তাঁর সেক্রেটারি এরকম সময় তাকে জিজ্ঞেসও করেছিলেন যে কেন তিনি পদত্যাগ করছেন না। তাজউদ্দিনের উত্তর ছিল- “মুজিব ভাই থাকতে আমি এটা করতে পারবো না। Let Bangabandhu take the decision and do it”. এবং হ্যাঁ! বঙ্গবন্ধু তা করেওছিলেন। তাজউদ্দিনকে মন্ত্রীত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
তাজউদ্দিন বাকশালের বিরুদ্ধে উচ্চকিত ছিলেন। সারাজীবন বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করে বাকশালকে তিনি মেনে নিতে পারেন নি। “মুজিব ভাই” এর প্রতি তাঁর ভয়ানক আনুগত্যও তাকে আদর্শের সাথে আপোষ করার সুযোগ করে দিতে পারে নি। ৭৫ এর জুন মাসে তাজউদ্দিন সামরিক কন্সপায়রেসির ব্যাপারে সাবধান করেন শেখ মুজিবকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তখন তাজউদ্দিনের কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেন নি। আগস্টে মুজিব পরিবার যখন খুন হয়, তাজউদ্দিনের প্রথম কথা ছিল- “মুজিব ভাই মৃত্যুর আগে হয়তো জেনে গেলেন না কে তাঁর আপন ছিল”।
সর্বশেষ তাজউদ্দিনের আরেকটা কথা, যা মাথায় গেঁথে থাকবে দীর্ঘদিন। তাজউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধের সময় সহযোদ্ধাদের বলতেন-“চলেন আমরা দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করি যাতে মুক্তিযুদ্ধের পর কোন ইতিহাসবিদ যদি খুঁজতে যায়, তারা যেন আমাকে/আমাদেরকে খুঁজে না পায় কোথাও”। কথাটা হয়তো এমন আহামরি কিছু নয়। এমন কথা অনেক নেতারাই নানা সময় বলেছেন, যা আবার সময়ের পরিবর্তনে Meme কিংবা ট্রলেও পরিণত হয়েছে। কিন্তু পার্থক্য এই যে, তাজউদ্দিন এই কথাকে সত্য প্রমাণিত করেছেন। এই ব্যক্তিপূজার দিনে এই কথায় তাই বুকে মোচড় দেয়।
এই সিনেমা নিয়ে কেন এত কথা লিখলাম? কারণটা খুবই ব্যক্তিগত। আমি গত কয় বছরে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার সকল গর্ববোধ, ভালবাসা সব শেষ হয়ে গেছে। এখন যেই আমার সামনে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলে আমি তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাই। মনে হয় তার কোন ফায়দা লোটার আছে। কিন্তু, এই ফিল্মটা দেখতে গিয়ে বুঝলাম- না সব শেষ হয়নি। ফায়দা না কামানো মানুষ ছিল, হয়তো এখনো কোথাও আছে। এই বিশ্বাস ফিরে দেওয়ার জন্য আমি তানভির মোকাম্মেলের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ।
আতিয়া ফেরদৌসী, পি এইচ ডি গবেষক, মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র।
ডকুমেন্টারির লিঙ্ক