সায়েমা খাতুন
৮ মার্চ ২০২০ বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণের খবর জানবার পরে সারাক্ষণ মেয়ের স্কুলে যাওয়া নিয়ে আতংক বোধ করতে শুরু করতে থাকি। প্রতিদিন মনে হয় স্কুলে কখন কার কাছ থেকে কি ছড়িয়ে পড়ে। আব্বা- আম্মার সামান্য হাঁচি – কাশির শব্দে সাক্ষাৎ মৃত্যুকে দেখতে পাই। আব্বার যে বিস্ফোরক হাঁচি নিয়ে এতো বছর হাসাহাসি করেছি, আজকাল তাতে আতংক বোধ করতে শুরুর করেছি। আব্বা-আম্মা বয়েস এবং ডায়াবেটিক নিয়ে দুজনেই উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দলে। হঠাৎ স্কুলের একটা বাচ্চার করোনা সংক্রমণের গুজব ছড়িয়ে পড়ে ওদের বন্ধুদের চ্যাটগ্রুপে। মেয়ে উত্তরার একটা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে যায়। স্কুলে ফোন করলে তারা বলে, এটা গুজব। কিন্তু আমি এই ভয় আর বহন করতে পারলাম না। ভাইরাস ঢুকে পড়েছে ভয়ে-আশংকায় ১৫ মার্চ রবিবার থেকে নিজেই বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছি। মেয়ের সামনে ফাইনাল পরীক্ষা, একটা টেস্ট ছিল সেদিন। স্কুলে ই-মেইল করে জানিয়ে দিয়েছি, আমি স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাচ্ছি না, তারা যেন ওর পরীক্ষা আর ক্লাসের উপস্থিতির বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় রাখেন। তারাও জানিয়েছেন , ওরা আমার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বুঝতে পারছে, এবং সেটাকে সম্মান করছে। কিন্তু যেহেতু শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এখনও নির্দেশ দেয় নি, স্কুল প্রশাসন নিজে থেকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে পারছে না। কেউ যদি নিজে থেকে স্কুলে আসা বন্ধ করে, সেটা তারা নিজেরা বিবেচনা করবে। যেটা বুঝলাম, বিশেষ করে সামনে ১৭ মার্চের বিশাল আয়োজন ভন্ডুল করে দেয়ার ঝুঁকি নেবার সাহস তারা করছিল না। ঝুঁকিটা আমাকেই নিতে হল। ফেসবুকে স্টেটাস দিলাম:
– টেনশন আর নিতে পারছি না, বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছি।
বন্ধু, আত্মীয়, শুভাকাঙ্খীরা সহানুভূতি জানালেন। বললেন,
-একদম ঠিক করেছো, আমরাও বন্ধ করে দিয়েছি।
-খুব ভালো কাজ করেছিস, ইত্যাদি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তরা রুটের বাসে জরুরী আলাপ শুরু হয়েছিলো, আমরা বাসে কিভাবে নিজেদের সুরক্ষা করবো, দূরত্ব রক্ষা করবো, কেউ সংক্রমিত হলে কি করা হবে, ইত্যাদি! আগের বৃহস্পতিবার নৃবিজ্ঞান বিভাগের নিয়মিত মিটিং এ আমি পুরো বিভাগ সানিটাইজ করবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সেটা খুব সিরিয়াসভাবে নেয়া হয়েছে বলে মনে হল না। কেউ কেউ বলছিল, আপনার পরিচিত কাউকে সংক্রমিত হতে দেখেছেন নাকি ? কিম্বা বাংলাদেশে মনে হয় না ওরকম কিছু হবে। অনেকে বল্ল, ঢাকার বিষাক্ত বাতাসে করোনা নিজেই টিকতে পারবে না।
আচমকা ১৭ই মার্চ ২০২০ বিনা নোটিশে বিশ্ববিদ্যালসহ গোটা দেশ বন্ধ ঘোষণা হওয়াতে মাসের বেতনও তুলতে পারিনি। চেকবইও ফেলে এসেছি অফিসের ড্রয়ারে। তারপর থেকে টাকা তুলতে পারিনি। ঘরে যা আছে, তাই দিয়ে একমাস চলেছি। এবারে ব্যাংকে যেতেই হবে। দরকারি অনেক কাগজপত্র, বই, ফাইলও রুমে রেখে এসেছি। আমার অনেক সহকর্মীদের অবস্থাও আমারই মতো। বিভিন্ন জরুরী বিষয়ে যোগাযোগ রাখছিলাম বিভাগের সভাপ্রধান অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌসের সাথে। উনি জানালেন অধ্যাপক মীর্জা তাসলিমাকেও ব্যাংকের জরুরী কাজে উত্তরা থেকে জাহাঙ্গীরনগর যেতে হবে । উত্তরার এক প্রান্তে আমি আর আরেক প্রান্তে সদ্য নতুন বাড়িতে উঠেছেন এই দুই সহকর্মীর পরিবার। আপা হাত তুলে দেখালেন,
– ঐ যে ওখানে আইসলেশন সেন্টার করা হয়েছে।
– আপনারা যে প্রতিবাদ করলেন, তাতে কিছু হল না?
– মনে তো হয় না কেউ কর্ণপাত করেছে !
দিয়াবাড়ীর রাজউকের বিরাট হাউজিং টাউনের খালি ভবনে সরকার আইসলেশন সেন্টার করবার ঘোষণা দেয়াতে এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত কি হচ্ছে ঠিক স্পষ্ট হল না। এখানে থাকা সহকর্মীদের কয়েকটি পরিবারকে নিয়ে দুশ্চিন্তা হতে থাকলো। কিন্তু এসব ভেবে কি লাভ? আমাদের বাড়ীর হাঁটা দূরত্বে কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালকে করোনা চিকিৎসার কেন্দ্র করা হয়েছে। এখন রুটে কোন বাস নেই, ড্রাইভার ছুটিতে। আমরা একসাথে জাহাঙ্গীরনগর গেলাম। দুইজনে দূরে দূরে বসলাম। আমার ছোটভাই আফতাব গাড়ি চালাচ্ছিল। সবাই মাস্ক আর গ্লাভস পরে আছি। সাথে আছে সবচেয়ে জরুরী জিনিস  স্যানিটাইজার।
উত্তরা থেকে যথারীতি বিরুলিয়া ব্রিজ দিয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখি, গ্রামবাসী রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে। গাড়ি ঘুরিয়ে আবারে আশুলিয়ার রাস্তা ধরলাম। রাস্তা একেবারে জনমানবশূন্য নয়, আশুলিয়া বাজার আধখোলা। ১৭ তারিখের পর এই প্রথম ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসেছি। দু’বার পাড়ার মুদি, ঔষধের দোকান আর বাড়ির ছাদ ছাড়া এই একমাসে ঘর থেকে আর কোথাও বের হইনি। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় লকডাউন করে রাখা হয়েছে। ফেসবুকের পোস্ট থেকে দেখছিলাম, বেগুনি হিজল আর কমলা রাধাচূঁড়ায় ভরে উঠেছে ক্যাস্পাস।
জানতাম, প্রধান ফটক বন্ধ। শুধু প্রান্তিক গেট খোলা। ব্যাংক সীমিত সময়ের জন্যে খোলা। তাই সময়ের মধ্যে পৌঁছবার তাড়াহুড়া ছিল। পৌঁছে দেখি, জনশূন্য ভবনের পাহারায় বসে আছে সমাজবিজ্ঞানের গার্ড।
-আপনার মাস্ক কই? আমরা জিজ্ঞাসা করলাম।
বললেন, পরে ছিলেন, এখন কিছুক্ষণ আবার খুলে রেখেছেন।
নৃবিজ্ঞান বিভাগের করিডোরে মাকড়শার জাল গজিয়ে উঠেছে, ভেতরে ধুলা জমে উঠেছে, ভৌতিক অন্ধকার। গা ছমছম করতে থাকলো, যেন মৃত্যুর ছায়া ঘুরছে চতুর্দিকে। জানি না, আমাদের মধ্যে কে বেঁচে থাকবো, আর কে থাকবো না। করিডোরে টবের গাছগুলো শুকিয়ে গেছে। তাসলিমা আপা গাছগুলোতে পানি দিলেন। চারদিক তাকিয়ে বললেন,
-কেমন সুররিয়েল দ্যাখো, একটা ছবি তুলে রাখি।
আমরা বিভাগের সাইনবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে মাস্ক পরা ছবি তুললাম।
অগ্রণী ব্যাংকের ভেতর কয়েকজন মানুষ, সবাই মাস্ক, গ্লাভস পরে কাজ করছে, ক্লায়েন্ট কয়েকজন মাত্র। আগামী দিনগুলোর জন্য বেশি করে টাকা-পয়সা তুলে প্রান্তিক গেটে এলাম। ঔষধের দোকান থেকে স্যানিটাইজার, টয়লেট পেপার, জীবানুনাশক ভেজা ন্যাপকিন, জিঙ্ক ট্যাবলেট, ভিটামিন – সি কিনলাম। বাড়িতে শাক-সব্জি নেই, বাজার নেই, কাজের লোক, ড্রাইভারকে আগেই ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে, বাজারে যাওয়া কঠিন। তাসলিমা আপা আর আমি তরকারীর দোকানে দাঁড়িয়ে যত পারি বেশি করে তরকারী আর ফল কিনতে দাঁড়ালাম। আপেল, আনারস, নাশপাতি আর বেশি করে কমলা আর মাল্টা কিনলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের গার্ড দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের পাশে, তার এখন ডিউটি নাই। ক্যাম্পাস, অরুণাপল্লী ও এর আশেপাশের গ্রামগুলো এখনও সংক্রমণমুক্ত আছে। জেনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো। সাভারে সংক্রমণ পাওয়া গেছে, লকডাউন করা হয়েছে। ক্যাস্পাসের প্রবেশপথে প্রতিবন্ধক দেয়া, প্রত্যেকটি গাড়িকে থামানো হচ্ছে। আমাদের গাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্টিকার লাগানো থাকাতে কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল না। তাছাড়া, আমাদের চেহারাও চেনা। জীবানুনাশক স্প্রে দিয়ে গাড়ি ধুয়ে দেয়ার পরে আমরা প্রবেশ করতে পারলাম। এখন কিভাবে এখানে সবকিছু চমৎকারভাবে চলছে গার্ড তার বর্ণনা দিলেন, কিভাবে তারা পালা করে ডিউটি দেন, বাইরে থেকে কাউকে ঢুকতে দেন না এবং ভেতরে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করেন। জীবানু সংক্রমণ, লকডাউন ও মানুষের মরণশীলতা সম্পর্কে তার সহজ ব্যাখ্যা হলো:
-করোনা কেবল ইনসানের শরীলে ঢুকে, আর কোন জীব-জানোয়ারের শরীলে ঢুকবে না, কোন জিনিসের ওপর টিকে থাকবে না। ইনসানের শরীল ছাড়া করোনা বাঁচে না। ইনসানের শরীল না পাইলে, করোনা চার ঘন্টার বেশি বাঁচে না। সাবানের ফেনাতে করোনা টিকে থাকতে পারে না। এই জন্য ইনসান একে অপরের কাছ থেকে ৬ ফিট দূরে থাকতে হবে। হাদিসে আাছে, যদি কোথাও মহামারি দেখা দেয়, তোমরা যে যেখানে আছে, সে সেখানেই থেমে যাবে, ভেতরে থাকলে তোমরা সেই স্থান থেকে বের হবে না, বাইরে থেকে থাকলে সেই স্থানে ঢুকবে না। এভাবেই ইনসান মহামারী থেকে রক্ষা পাবে। এই আমাদের জন্য এক কঠিন পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় আমাদের পাশ করতে হবে। জীবন আল্লাহ দিয়েছেন, নিবেনও তাঁর ইচ্ছায়। হায়াত-মওউত সবই আল্লার হাতে। জীবন তো একদিন শেষ হবে। সবাইকে আল্লার উপর ভরসা করতে হবে। আল্লাই যখন দুনিয়াতে মানুষকে পাঠাইছেন, মারবার জন্যে পাঠান নাই। তাই আমাদের নিয়ম মাইনা চলতে হবে। ভাইরাসের এই নিয়ম মানলে করোনা আমাদের মারতে পারবে না।
তার এই লোকভাষ্যের বয়ান আর আইসোলেশনের বৈজ্ঞানিক বয়ান আমার কাছে খুব কাছাকাছি মনে হল। খুব স্পষ্ট, প্রাঞ্জল আর আশাবাদী মনে হল।
এক তরকারীওয়ালা তার বাড়িতে ফলানো শাক-সব্জি নিয়ে বসেছেন প্রান্তিক গেটের বাইরে । বললেন,
– আমার বাড়িতে চাষ করা তরকারী নিয়া যান আফা ।
আমি আর তাসলিমা আপা প্রচুর পরিমানে সবুজ শাক-সব্জি কিনে নিলাম: লতি, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, চিচিঙ্গা, ঢেড়শ, বরবাটি, কাঁচা কলা, কলমী শাক, পালং শাক, ধনে পাতা, কাঁচা মরিচ, লেবু। ফিরতে ফিরতে একটু কথা বলার সময় পেলাম, কার কি অবস্থা। টাকা-পয়সা, খাবার-দাবার, ঔষধপাতিসহ, যার যার ঘরে ফিরে এলাম আমাদের নতুন লকডাউন জীবনের আইসোলেশনে গুছিয়ে বসবার জন্যে। বিদায় নেয়ার সময় বল্লাম,
– সাবধানে থাকবেন। যদি এই যাত্রা বেঁচে যাই আবার দেখা হবে!
সোমবার, ২০ এপ্রিল ২০২০
উত্তরা, ঢাকা
Image courtesy: author
সায়েমা খাতুন, সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
0 Shares

Leave A Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 5 =