সারিনা সামিন
যখন চীনে প্রথম করোনাভাইরাস হানা দেয়, আমি ভাবলাম, পৃথিবীতে আরো কত রকমের রোগ আছে- প্লেগ, কলেরা, সার্স– করোনাও হয়তো তেমন কোন রোগ। পরে জানতে পারলাম, এটা অন্যগুলোর চেয়ে ভয়ংকর। যদিও আগে থেকে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতাম, সুরক্ষা নিয়ে থাকতাম; এখন আরো সুরক্ষা নিয়ে থাকি। যেমন খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে নিই, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলি। মার্চ মাসে আমাদের পরীক্ষা ছিল। কিন্তু ছুটি দিবে বলে সব পড়া তাড়াতাড়ি শেষ করে দিয়েছে। এক পিরিয়ডে মাঝে মাঝে দুইটা সাবজেক্টও পড়াত। পরে ১৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান ছিল। এর পর থেকে এক মাসের মতো ছুটি কাটাচ্ছি। এই ছুটিতে শুরু হয় এক ধরনের বন্দী জীবন।
ঠিক ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার আনা ফ্রাঙ্ক-এর ডায়েরির মতো। এই আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি কয়েকদিন আগে শেষ করেছি। যখন জার্মানিতে ইহুদিদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন করা শুরু হলো আনা ফ্রাঙ্ক ১৯৪২ সালের জুনের ১৪ তারিখ থেকে ডায়েরি লেখা শুরু করেন। আনা ফ্রাঙ্কের আরেক বোন আছে, মারগোট। বাবার নাম অটো ফ্রাঙ্ক আর মায়ের নাম এডিথ। ধর্ম ইহুদি। ১২ জুন জন্ম নেন আনা। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় অত্যাচার শুরু হলে অটো ফ্রাঙ্ক দেশ ছেড়ে হলান্ড চলে গেলেন ১৯৩৩ সালে। আনা ফ্রাঙ্কের বয়স তখন ৪ বছর। ১৩ বছর থেকে আনা ডায়েরি লেখা শুরু করে। তারপর দুই বছর দুই মাসের লেখা। সেই দুই বছরের কাহিনী পড়া শেষ করেছি।
তারপর ‘হাঁকলেবেড়ি ফিন’, ‘ট্রেসার আইলান্ড’, ‘আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ’ পড়েছি। এই তিনটিই কিশোর ক্লাসিক। স্কুল থেকে পড়তে আনা বই। বাসার সবগুলো বই পড়ে ফেলার কথা ভাবছি। এই সময় এটা লিখতে খুব ভালো লাগছে। ক্লাসের পড়াও পড়ি। প্রতিদিন কুরআন ও নামাজ পড়ি। বন্দী জীবন কাটানোর অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে আর এর ফলে ঘুম থেকে মাঝে মাঝে দেরিতে উঠি। মাঝে মাঝে সকালে নাস্তা খাই না, দুপুরে একসাথে খাই। মাঝে মাঝে মায়ের সাথে রোজা রাখি। তিন বছরের বোনের সাথে খেলি। ওর সাথে বারান্দায় থাকি।
সারা দিন ঘরবন্দী থাকলেও বিকাল বেলা পুরোটা সময় বারান্দায় সময় কাটাই। নিচে খেলতে যাওয়ার বদলে বারান্দায় থাকিI বারান্দায় বসে অনেক কিছুই করি। সামনের বিল্ডিং-এর মেয়েটাও ওর বাসার বারান্দায় আসে, ওর সাথে কথা বলি । পরে সন্ধ্যায় পড়তে বসি, স্কুলের ওয়েবসাইট থেকে যা পড়া দেয়, সেগুলো ফলো করি। সকালে স্কুলে যাবার তাড়া নেই, তাই দেরিতে ঘুমাই। চট্টগ্রাম শহরে আমরা যেখানে থাকি, সেখানে অনেক আগে থেকেই আইসোলেটেড এক ধরনের ভাব চলছে। এখনে মানুষ বাসা থেকে বের হয়ই না। জানালা, বারান্দা দিয়ে দেখি, শুধু বাসার গার্ড, দারোয়ানরা হেঁটে বেড়ান। তারাও দূরত্ব নিয়ে থাকেন।
বোনের সঙ্গে নতুন নতুন অদ্ভূত রেসিপি করি। স্কুল-স্কুল খেলি, স্টিকারকে ব্যান্ডেজ ভেবে ব্যথা পেয়ে স্টিকার হাতে-পায়ে লাগাই, আবার খুলে ফেলিI মোবাইল ছবি তুলি বিড়ালের কান পরে। ফোনে কথা বলি। মেসেজ পাঠাই অনেক জায়গায়ই। আগে যখন বাইরে থেকে কেউ আসত, সবসময় আমার ছোট বোন দরজা খুলতো, কিন্তু এখন তো আর তাকে দরজা খুলতে দেওয়া হয় না! কিন্তু তারপরও ও দরজা খুলতে চায়। যেহেতু এখন বাইরে যাওয়া নিষেধ, এবারকার নববর্ষ উদযাপন আমরা ঘরে করেছি। আমরা দুই বোন, আমার অনেকগুলো বই একত্রিত করে বইয়ের দোকান সাজিয়েছি। আমরা অনেক আনন্দ পেয়েছি!
করোনাভাইরাসের আপডেট নেই। এই ভাইরাস চোখে দেখা যায় না, কিন্তু কত ক্ষতিকর! আমরা এই করোনা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি। এই ভাইরাস থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য বার বার হাত ধুতে হবে, হাঁচি-কাশি আসলে মুখ ঢাকতে হবে, এমন অনেক স্বাস্থ্যবিধি সবাই শিখছে। আমাদের একটাই আশা, আমরা সবাই যেন ভালো থাকি, বিপদমুক্ত ও নিরাপদ থাকি ।
সারিনা সামিন, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল এন্ড কলেজের (সিইএসসি) ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
Pingback: করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত দিনাতিপাত – ANTHROPOLOGY JOURNAL
A great piece by a young reader!