আলা উদ্দিন
এক মাসের বেশি সময় ধরে আমরা করোনাতঙ্ক, গৃহবন্দী। জীবন এখন কেমন, যেমনটি ছিল না কখনও, অজানা ভাবনায, কাটছে দুশ্চিন্তায়! দু-চার কাপড়ে দিনের পর দিন অতিবাহিত করছি; কখন উঠছি, কখন ঘুমাচ্ছি কোন ঠিক-ঠিকানা নাইI না আছে খাবার, কিংবা অন্য কোনো কাজের ঠিক! কাজের চাপ নাই, কিন্তু সদা থাকি উৎকণ্ঠায়I কী হচ্ছে, কী হবে!! সারাদিন বিষন্ন মন, চিন্তায় ব্যাকুল, ডুবে থাকে মন ভাবনায় — অকূল-পাথারে!
সকাল-সন্ধ্যার হিসাব নাই, তবে প্রতিদিন রুটিন কাজ, গ্রামের বাড়িতে থাকা বৃদ্ধ বাবা-মায়ের খবর নেয়া! গ্রামের দিকে যে অবস্থা, কখন কী হয়, তাই সদা ভয় হয়! আজকাল শহরের অবস্থায় ভালো নয় ! এতদিন টেস্ট ছিল না, বোঝা যায় নি — এখন টেস্ট করলেই পসিটিভ রিপোর্ট! সাধারণ মানুষও স্বাস্থ্যবিধি মানতে চায় নাI কারো সাথে আলাপ খুব একটা হয় না, বিষয়বস্তু বলেতো আর অন্য কিছু নাই! ‘কেমন আছেন’, ‘সাবধানে থাকবেন’! কেউ খুব একটা ফোনও করে না। আমার এপার্টমেন্ট-এ আমার আরও পাঁচ সহকর্মী থাকেন, দেখাতো হয়- ই না, কথাও হয় না । এখন আমরা প্রত্যেকে নিজের তরে!
এর মধ্যে দিনের হিসাবে লেগে গেল গোল! কোনদিন শনি, কোনদিন রবি, ভুলে গেছি সব-ই! আযান কিংবা রাস্তায় লোক-সমাগম নাই, তাই শুক্রবারও গেছি ভুলে! মনে হয় ২/৩দিন পর পর-ই বুঝি শুক্রবার চলে আসে । করোনাতঙ্ক আর ভাবনার দোহাই দিয়ে পড়ালেখাটাও গেছে! তবু সময় চলে যায়, দিনটা ছোট হয়ে গেছে বলে!
ফেসবুকে চ্যাটিং খুব একটা হয় না, আগের মতো ভালো লাগে না! হালকা আবহের নাটক আর সিনেমা দেখি প্রতিদিন! তবে বিটিভি দেখতে পারলে ভালো হতো! এই বিধ্বস্ত সময়ে সবচেয়ে ফলপ্রসূ টনিক হচ্ছে নিয়মিত বিটিভি দেখা; যেখানে কেবল তেলেসমাতি প্রশান্তি– সারা পৃথিবী জুড়ে অশান্তি/উৎকণ্ঠা; তথাপি, বাংলাদেশে স্থিতিশীল, সারা দেশ শান্তিময়-সুখময়; সর্বত্র কেবল উন্নয়ন আর নিয়ন্ত্রণ ।
ঘুম এবং জাগার নাই ঠিক। সকালের খাবার হোক বা না হোক, বাকি দুই খানা হয় না, তা বলা যায় না ! দুপুর আর রাতের খাবারের সময়কালীন একটাই অভিন্ন আলাপ–কী আছে, কী লাগবে! এই ভেবে ভেবে আজকাল ভাত-তরকারি কমই খাওয়া হয়! একদিক থেকে ভালোই হলো! এখন অবশ্য রমজান মাস ! তাই দুপুরে আর খাওয়া হয় না !
প্রতিদিনের আরেকটি নিত্য ভাবনা, দুই কন্যার কী লাগে, আর কী লাগবে! যত্ন করে হিসাব কষে তালিকা করি; কারণ, জিনিসপত্র আনতে হবে পরিকল্পনা করে – এক সাথে! দারোয়ানের সাথে সদ্ভাব রাখি, তাকে পাঠাই পাশের মুদি দোকানে। আগে থেকে ফোনে অর্ডার দিয়ে রাখি! সব্জিওয়ালার কাছেও টাকা জমা রেখেছি, অর্ডার দিয়ে রাখি, দারোয়ান গিয়ে নিয়ে আসে!
বাসার কাজের মানুষের ছুটি সেই শুরু থেকে। ঘরে অল্পস্বল্প কিছু কাজ করি। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো, মীনা কার্টুন আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দেয়- ঘরের কাজ, মেয়েদের কাজ, আর পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বা হাতধোয়ার প্রয়োজনীয়তা।
বড় মেয়ের বয়স দশ। সেও ঘরে টুকটাক সাহায্য করে! আর ছোট্টটি (তিনের কম বয়স) আমাদের সবাইকে প্রাণবন্ত রাখে! তারা ঘুম থেকে ওঠে সকাল ১১/১২ টার পর! আর ঘুমায় রাত ১২/০১ টার পর । ছোটটাকে ঘুম পাড়াতে রাজ্যের কষ্ট! তবে কোনদিন ৮/৯ টায় ঘুমিয়ে গেলে ঘরটা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে! তার কাজ দুটো: বড় বোনের সাথে খেলা এবং ঝগড়া করা, আর পড়ার রুমে আমার পাশের চেয়ারে বসে বসে কার্টুন (নাস্ত্যা, গাবি, ইত্যাদি) দেখা! বড়টা একটু-আধটু পড়ে, আর মা আর ছোটটির সাথে লাগে। মা’র সাথে কিছু ধর্ম-কর্মও করে! পহেলা বৈশাখের দিন তারা দুই বোন বড়টির সংগৃহীত বেশ কিছু বই নিয়ে বাসায় একটা বুকস্টোর দিয়েছে ঘরে ! এটাই তাদের ১৪২৭-এর নববর্ষ উদযাপন!
লকডাউনে থাকাকালীন কয়েকটি পর্যবেক্ষণ:
১. এখানে সরকার ও জনগণ একসূত্রে গাঁথা! সাধারণ মানুষ লকডাউন মানতে নারাজ! ঘরের বাইরে না গেলে তাদের চলেই না! যাদের বাইরে যাওয়া জরুরি না তারাও আর ঘরে থাকতে চায় না !
২. এখানে আইসোলেশনেও প্রেম হয়, বিয়ে হয়! কোয়ারান্টিনে মানুষ কিভাবে থাকে তা দেখতেও ভীড় হয় !
৩. টেস্ট না করানো পর্যন্ত সবাই সুস্থ — টেস্ট করলেই বিপদ! সকালে পজিটিভতো বিকালে নেগেটিভ রিপোর্ট!
৪. প্রথম পরীক্ষায় পসিটিভ এলেও দ্বিতীয় পরীক্ষায় নেগেটিভ রিপোর্ট আসে! যেমনটা এসেছে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের! তবে এই সুযোগ সবার জন্য না!
৫. এখানে রোগীর মাঝেও সাধারণ- অসাধারণ (ভিআইপি) শ্রেণিবিভাজন সুস্পষ্ট!
৬. গার্মেন্টস-সহ বেশিরভাগ ব্যবসায়ী এই দেশে দুর্যোগকালে ‘ওয়ার-ক্রাইম’ বিজনেস করতে উদ্যত, ‘ওয়ার-টাইম বিজনেস নয় !
৭. অভাবী-কর্মহীন মানুষের ঘরে ঘরে অর্থ ও খাবার নিশ্চিত না করা গেলে লকডাউনের সুফল আসবে না !
৭. মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আমরা মহামারী প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত নই !
আলা উদ্দিন, অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম । যোগাযোগ : [email protected]