নাজনীন শিফা
একজন তরুণ গার্মেন্টস শ্রমিকের কারখানার ভিতর থেকে করা একটা লাইভ ভিডিও দেখে এবং তার সাহসী বক্তব্য শুনে কিছুটা থমকে গেলাম। সপ্তাহ দুয়েক আগেই ডয়েচেভেল এর সাথে একটি আলোচনায় বিজিএমইএ’র সভাপতি রুবানা হক অনুষ্ঠান উপস্থাপকের খুবই যৌক্তিক একটি প্রশ্নের জবাবে খানিকটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলছিলেন আপনারা সবসময় খোঁচা দিয়ে প্রশ্ন করেন, কিন্তু এখন এই পরিস্থিতিতে এইসব প্রশ্ন করার সময় নয়, বরং এই মুহুর্তে আমাদের একসাথে কাজ করাটা জরুরী। এই পরিস্থিতিতে একসাথে কাজ করার জরুরত্ব নিয়ে আমার কোন দ্বিমত নেই। সেই বক্তব্যের বিষয়টি এখানে উল্লেখ করছি এইজন্য যে, আলোচ্য তরুণ শ্রমিক ভাইটির ভিডিও বার্তায় এমন অনেকগুলো প্রসঙ্গ উঠে এসেছে যা এখন আলোচনা করলে অনেকেই বলতে পারেন করোনা অতিমারীর এই সময়ে এই আলোচনা ঠিক নয়। শ্রমিক ভাইটির বক্তব্যটি পাঠকের সামনে তুলে ধরার আগে এইটুকু বলতে চাই সঠিক সময়ে সঠিক প্রশ্নটি করতে পারা জরুরী কাজ এবং এই মুহুর্তে এই বিষয়েতো বটেই। তাহলে কিছু মানুষের জীবন অন্তত বাঁচে। এটা একটা সুযোগ ভুলত্রুটিগুলোকে ফিরে দেখার।
শ্রমিক ভাইয়ের বয়ানটি এখানে তুলে ধরা হলো:
.…..এখন কথা হইল সরকারি ছুটি দিন দিন বাড়ে, পাঁচদিন বাড়ে, দশদিন বাড়ে, বাড়তেই থাকে। গার্মেন্টস শ্রমিকের ব্যাপারে সবাই কাজ কর, কোন সমস্যা নেই। অন্যসময় সবাই বলে, সরকার, তারপর বড় বড় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশান, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য, তারপর হইল আপনার বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ যতকিছু আছে, সবাই বলে গার্মেন্টস শ্রমিকরা হইল দেশের রত্ন, বিদেশ থেকে রেমিটেন্স আনে, এটা সেটা অনেক কথা, মানে গার্মেন্টস শ্রমিকদের [প্রতি] ভালবাসা রাখার জায়গার অভাব নাই। কিন্তু যখন গার্মেন্টস শ্রমিকরা এরকম পরিস্থিতিতেও কাজ করে, এই যে মনেকরেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা মহামারির মত সময়েও কাজ করে তখন কারো দেখার টাইম নাই। তখন গার্মেন্টস শ্রমিকরা সবার কাছে রোহিঙ্গা। ঠিক আছে, বাংলাদেশে দশ লক্ষ রোহিঙ্গা আইছে। আর আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকরা যারা তারা হইলাম পঞ্চাশ লক্ষ রোহিঙ্গা, বর্তমান বাংলাদেশে ষাট লক্ষ রোহিঙ্গা……এরা বাঁচলেই কী, আর মরলেই কী। এদের জীবনের চার আনা দাম নাই…………
…….. আজকে বিজিএমইএ দেখায় গার্মেন্টসের মধ্যে যারা কাজ করে অনেক দূরে ফাঁক ফাঁক রাইখ্যা, দূরত্ব বজায় রাইখ্যা কাজ করে, ঠিক আছে। কিন্তু আমরা যারা গার্মেন্টসে কাজ করি, তারাই জানি গার্মেন্টসের কী অবস্থা। এই যে চুল টুল সব সাদা হয়ে গেছে। এই দেখেন ময়লায় এইগুলা প্রতি দুই মিনিট পরপরও যদি পরিস্কার করি তাহলেও ময়লা দিয়ে আমার ফেস ভরে যাইব। এইখানে কাজ ফালায় থুইয়া আধা ঘন্টা পর পর আমার শরীর, হাত পরিস্কার করতে পারব না। কোন ভাবেই সম্ভব না। এই যে এক পিস বডি যখন সেলাই করব, বডি সেলাই করা শেষ, আমার হাত থেকে আরেকজনের হাতে যাবে। তারপর আরেকজনের হাতে যাবে। ……কখোনোই সম্ভব না, কাজ রেখে দুই মিনিট পর পর হাত ধোয়া। দুই মিনিট পর পর মুখ ধোয়া এটি কোনভাবেই সম্ভব না, এটা শুধু মুখেই বলা সম্ভব। যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিধি আমরা মেনে চলতেছি। এগুলো মুখেই বলা সম্ভব, এগুলো প্রাকটিক্যালি করা সম্ভব না, কখনোই না। যারা এই কথাগুলো বলে তাদেরকে এনে যদি গার্মেন্টসে বসায়ে দেয়া যায়, যে আপনি কাজ করেন, প্রাকটিক্যালি দেখবেন। এই যে রমজান মাসে কাজ করি, এক মিনিট কম কাজ করা যাবেনা। প্রতি ঘন্টার টার্গেট প্রতি ঘন্টায় দেওয়া লাগবে……….।
……কথা হলো উচিত কথা বলতে নেই। উচিত কথা বলব, কালকে সবাই আমার ভুল ধরবে। সবাই আমাকে নিয়ে উল্টা পাল্টা কথা বলবে। এই ছেলে এই কথা বলছে। এই যে ভাই আজকে যে আমি বাংলাদেশের নাগরিক হইয়া, আপনারা সরকারি লোকজন সব ঘরের মধ্যে আরামে থাকেন, সব ঘরের মধ্যে ছুটি কাটান, আর গার্মেন্টস শ্রমিকের বেলায় কোন ছুটি নাই, কিছু নাই, এক মাস বসায়ে বেতন দেওয়ার মত যোগ্যতা ও আপনাদের নাই। আর আপনারা আজকে ডিজিটাল বাংলাদেশ, আপনাদের শ্রমিক ঐক্য, আজকে আপনাদের বিজিএমইএ, ঠিক আছে, সবমানে [পড়–ন সবকিছু] আপনাদের জন্য…….
বিজিএমইএ, শ্রমিক ঐক্য ফ্রন্ট যারা বলে যে আমরা গার্মেন্টস শ্রমিকদের পাশে আছি, তোমরা চালায়া যাও, এটা সেটা, আন্দোলন হবে । তারাও আজকে নাই, সবাই লুকাইয়া গেছে, মায়ের আচলের নীচে লুকাইয়া গেছে সবাই। তো এই যে গার্মেন্টস শ্রমিকরা যদি এখন চুপ করে থাকে, যদি মুখ না খোলে, এই যে জায়গায় জায়গায় শ্রমিক ছাটাই করে এগুলো কেউ থামাইতে পারবনা। আজকে আমাকে ছাটাই করছে, কালকে আরো দুইজনকে ছাটাই করবে, এরপরদিন আপনাদের সবাইকে ছাটাই করবে। আপনারা কেউ কিছু করতে পারবেন না। …… গার্মেন্টস শ্রমিকের নিরাপত্তা নাই। আজকে গার্মেন্টস শ্রমিকেরা কেন এইভাবে কাজ করবে? সরকারি ছুটি যদি বাড়ে, অনান্য খাতের ছুটিগুলি যদি বাড়াইতে পারে তাহলে গার্মেন্টস শ্রমিকের যে নিরাপত্তা দেওয়া দরকার, তাদের সেটা দিচ্ছে না কেন? আপনারা শুধু মুখে মুখেই বলবেন রেমিটেন্স যোদ্ধা, বিদেশ থেকে যে অর্থ উপার্জন করে। আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিক ভাইয়েরা বাংলাদেশের মুখ উজ্জল করে। তাই এইগুলা মুখে বলেতো দরকার নেই আপনাদের।
যখন গার্মেন্টস শ্রমিক বিপদে আছে, কোন ঐক্য ফ্রন্ট নাই, কোন নেতা নাই , দল নাই, বিজিএমইএ নাই। সবাই আছেন আপনাদের পকেট নিয়ে, নিজের ধান্ধায়। নিজের পকেট ভরল, নিজে বাঁচলাম তাইলেই ঠিক আছে। ……ঐ গার্মেন্টস শালার শ্রমিকেরা আবুল একটা একটা। ওদের মনে কোন সাহস নেই, একটা প্রতিবাদ করার মত। আজকে আমি লাইভে আইছি, জানিনা দুদিন পর কী হবে। আমার চাকরী থাকবে কিনা, নাকি সত্য কথা কওয়ার জন্য আমি কই যাব জানিনা। আপনারা চুপ রইছেন কেন? সবাই মাঠে নামেন। সবাই রাস্তায় নামেন। গার্মেন্টেসে কাজ কইরা যদি আমাদের মধ্যে ভাইরাস ছড়ায় যায়, শালা মরব যখন, আরো দশজন কে সাথে নিয়ে মরব। রাজপথে নামেন সবাই। আন্দোলন ছাড়া এই দেশে কিছুই হয়না। আজকে আন্দোলন করবেন, আপনার জন্য সবকিছু ঠিকঠাক আছে। আন্দোলন ছাড়া এই বাংলাদেশে কী পৃথিবীর কোথাও আন্দোলন ছাড়া কিছুই হয়না, আর এই বাংলাদেশে আন্দোলন ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ কিছু করতে পারিনি। আন্দোলন করছে, তারপর বলছে আন্দোলনে নামল এটা সেটা, তখন দেখবেন আপনার কত ঐক্য ফ্রন্ট আছে, শ্রমিক নেতারা আছে, সব বাইর হবে। ঠিক আছে। এই যে আসেন আন্দলন করব। কারণ তাদের পকেট ভরবে তখন। আর এখন শ্রমিকরা চুপচাপ, তো আমাদের নেতারাও চুপচাপ, ঐক্য ফ্রন্টের নেতারা চুপচাপ, শ্রমিক ফেডারেশানের লোকজন সব চুপচাপ, তো কথা এটাই, চুপচাপ আর থাকা যাবেনা। আজকে আপনি যখন চুপচাপ থাকবেন তখন আপনার সামনে আরো ১০ জন শ্রমিককে না করে দিছে, চাকরী থেকে ছাটাই করে দিবে। আমরা কিছু বলিনি। যদি এখন কিছু না বলি দু’দিন পরে যখন আমাকে ছাটাই করবে আমি কিছু বলতে পারব না, আর দশজনও বলতে পারবে না।
….এই যে ৬০% বেতন, ঠিক আছে। একটা ডিজিটাল দেশ এটা, সবাই বলে মধ্যম আয়ের দেশ এটা। এই দেশের মানুষ এত উন্নত, তারপর গার্মেন্টস শ্রমিকের যখন এই দুর্দশা, সাধারণ লোকজন সরকারি ছুটি কাটায়, তখন গার্মেন্টস শ্রমিককে ৬০% বেতন দেয়া হয়, লেঅফ এর আইন, ২০০৬ এর আইন আইন্যা তাদেরকে ৬০% বেতন দেয়া হবে। ৬০% বেতন কত ভাই? আমার ঘর ভাড়া চার হাজার টাকা, আর দোকানে যে আমি খাব, এতদিন খাইছি সেখানে আমার বাকী পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। মোট ১০ হাজার টাকা, কিন্তু এখন আপনি ৬০% বেতন আমাকে দিবেন, তিন হাজার টাকা। এই তিন হাজার টাকা আমি ঘরভাড়া দিব, দোকানে দিব, নাকি খাব, নাকি চিকিৎসা করব। কীভাবে চলব বলেন? বলার মত কেউ নেই। আজকে যে আমি লাইভ করতেছি এই লাইভ দেখার মতোও তো কেউ নাই। কথা একটাই ভাই, যদি আমরা আজকে এক না হই, সবাই যদি একসাথে আওয়াজ না তুলি তাহলে অসম্ভব। তাই এই, কোনভাবেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাঁচানো যাবেনা। লাশের মিছিল শুরু হয়ে যাবে। লাশের মিছিল থামাইতে পারব না। ….আজকে একটা দল আসল গার্মেন্টস শ্রমিকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য, দাঁড়ায়নি। একটা নেতা আসে নাই, একটা সরকারি দল আসেনাই গার্মেন্টস শ্রমিকদের পাশে দাড়ানোর জন্য। …..যাই হউক ভাই, অনেক দেখলাম জীবনে। সরকার নিয়ে, বিরোধী দল নিয়ে, আমার কিছু বলার ছিল না এতদিন, কোন অভিযোগ নাই। এখন কথা হলো আমার জীবনে যখন নিরাপত্তা নাই, তখন অভিযোগ আমি করব। আমার করার অধিকার আছে। …এতগুলা মানুষকে যে বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে এইভাবে কোন দেশ চলতে পারেনা! (ঈষৎ সংক্ষেপিত)
তরুণ শ্রমিকের এই এগারো মিনিটের ভিডিও বক্তব্যটি বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্প ব্যবস্থাপনার একটা দৈন্যদশাই তুলে ধরে, যেখানে তিনি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে পুরো ব্যবস্থাপনার দূর্বলতা নিয়ে। যেটা ‘স্বাভাবিক’ পরিস্থিতিতে জিডিপি, ‘মাথাপিছু আয়’, ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ এইসব বক্রোক্তি দিয়ে ম্যানেজ করা গেলেও অতিমারীর এই পরিস্থিতিতে এর দুর্বলতাগুলো আলগা হয়ে পড়েছে। শ্রমিক ভাইটির বক্তব্যের অনেকগুলো দিক রয়েছে, যা গভীর এবং বিস্তারিত বিশ্লেষণের দাবী রাখে। যেটা ঠিক এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং শ্রমিক ভাইয়ের বয়ানটি পাঠকের সামনে তুলে ধরা এবং প্রশ্ন গুলোকে আরেকটু এগিয়ে নেয়াই উদ্দেশ্য।
আমরা গত দেড় মাসে যা দেখেছি গার্মেন্টস শ্রমিকদের ছুটি দেওয়া, আবার হঠাৎ করে এই লকডাউন পরিস্থিতিতে কাজে ফিরতে বলা, সমালোচনারমুখে সকল কর্তৃপক্ষেরই শ্রমিকদের ফিরতে বলার দায় অস্বীকার করা এবং পরবর্তীতে আবারো একই পরিস্থিতির অবতারণা করা- সবই ছিল সরকার, বিজিএমইএ, গার্মেন্টস মালিকসহ সকল কর্তৃপক্ষের মধ্যে সম্মন্বয়হীনতার বহি:প্রকাশ, যা অনেকেই বলছেন। কিন্তু এটাকি শুধু সম্মন্বয়হীনতার মত সুশীল শব্দ দিয়ে বোঝা যাবে? নাকি এটা সার্বিকভাবে আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজে শ্রমজীবি মানুষের প্রতি যে অন্তর্নিহিত অবহেলা তারই বহি:প্রকাশ? শ্রমিক ভাইটি তার বক্তব্যে গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রতি অবহেলা বোঝাতে রোহিঙ্গা শব্দটি বার বার ব্যবহার করেছেন, যেমন: “আমরা রোহিঙ্গা”, “আমরা রোহিঙ্গাদের চাইতে নীচু জাত” ইত্যাদি। রোহিঙ্গা শব্দটির এই মেটাফোরিক ব্যবহারের যে প্রশ্নটি নিয়ে আমাদেরকে ভাবতে বাধ্য করে তা হচ্ছে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের শ্রেণীগত ও জাতিগত (এথনিসিটি অর্থে) বৈষম্যের দিকটি। এর মধ্য দিয়ে তিনি বার বার যে প্রশ্নটি তুলেছেন এই রাষ্ট্রে নাগরিক হিসেবে সবাই আমরা সমান নই। যেটা এই করোনা অতিমারীর কালে শ্রমিকদের প্রতি রাষ্ট্রের বৈষম্যমূলক আচরণ আরো স্পষ্ট করে তোলে (সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিকত্বের শ্রেনীগত বৈষম্যের প্রশ্নটি কেউ কেউ লেখালিখি এবং অনলাইনভিত্তিক আলোচনায় তুলেছেন, যেটা এখানে আমি বিস্তারিত করব না)। শ্রমিক ভাইয়ের বক্তব্যের যে অংশটি আমার কাছে স্ট্রাইকিং লেগেছে সেটা হলো, তার বক্তব্যে বার বার যে হতাশা প্রকাশ পেয়েছে, যে এইরকম একটি সময়ে গার্মেন্টস শ্রমিকের দেখার কেউ নেই, পাশে এসে দাঁড়াবার কেউ নেই। এই হতাশা কে আমরা কিভাবে পাঠ করব? শ্রমিক ভাইয়ের বক্তব্যে গভীর হতাশা কেন? ভ্যাকুয়ামটা কোথায়?
এই প্রসঙ্গে এটুকু বলতেই হয় সমস্যাটি আসলে শুধু বর্তমানে সীমাবদ্ধ নয়। এই সমস্যা বুঝতে হলে অতীতকে ফিরে দেখা জরুরী। এইরকম শ্রমঘন এবং শ্রম শোষণের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা শিল্প কারখানায় শ্রমিকের এই হতাশা দূর করতে শ্রমিকদের সংগঠিত রাজনীতির কোন বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কেমন রাজনীতি? বাাংলাদেশেতো অনেক শ্রমিক ইউনিয়ন, ফেডারেশান বা শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। তবে দেখা দরকার এই শ্রমিক ইউনিয়ন বলি, ফেডারেশান বলি তারা প্রতিটি ধাপে ধাপে কতটুকু সংগঠিত। কতগুলো শ্রমিক সংগঠনের নাম আমরা বলতে পারব যারা এই রকম কারখানাভিত্তিক ব্যাসিক ইউনিয়ন তৈরির মাধ্যমে কাজ করছে বা করতে পারছে? সত্যিকার আর্থে এই প্রশ্নের সরাসরি এককথায় কোন উত্তর দেয়া সম্ভব নয়।
প্রায় চল্লিশ বছর ধরে একটু একটু করে বড় হওয়া এই শিল্পে শ্রমিক সংগঠনের এই বেহাল অবস্থা কেন? তারা শ্রমিকের বিপদে কাছাকাছি থেকে কাজ করতে পারছে না কেন? তাই বলছিলাম এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ইতিহাসকে ফিরে দেখা খুব জরুরী, যেখানেই নিহিত আছে এর উত্তর। দীর্ঘ সময় ধরে বাঁধা গ্রস্থ হয়ে হয়ে, কখনো গার্মেন্টস এর কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষার, কখনো স্থানীয়ভাবে শ্রমিক আন্দোলনকে ঠেকিয়ে দেয়ার জন্য মাস্তান তন্ত্রের ব্যবহার, আবার কখনো আন্তজার্তিক শ্রম সংগঠনের চাপে, বা বায়ারের রিকয়ারমেন্ট পূরণে শ্রমিক ইউনিয়ন কে প্রমোট করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে শ্রমিক সংগঠনের পরিস্থিতি ক্রমেই জটিল হয়েছে। নানা স্তরে যে শ্রমিক রাজনীতি এবং সংগঠন তৈরী হয়েছে যার ঠিক কোন স্পষ্ট চেহারা নেই। বাম ধারার শ্রমিক সংগঠনের বাইরে অনেক শ্রমিক সংগঠনকে এনজিও বা বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সহযোগি সংগঠন হিসেবেও কাজ করছে বলে মনে হয় [ এই বিষয়ে আরো দেখুন] এরা ঠিক শ্রমিককে সংগঠিত করে কাজ করার চাইতে এক ধরনের প্রেট্রন-ক্লায়েন্ট সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কাজ করে। আপাতদৃষ্টিতে মনেহয় আন্তর্জাতিক বানিজ্য ব্যবস্থাপনার সাথে কাজ করার জন্য এরাই হয়ত উপযোগী রিসোর্সের দিক দিয়ে। এদিকে যে সকল শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে তারা অনেকেই বিশ্ব পুঁজির ব্যবস্থাপনার মধ্যে শ্রমিক রাজনীতিকে কিছুটা শ্রমিক-মালিক-সরকার সম্পর্কের মধ্যদিয়ে বিশ্লেষণ করছেন। এরফলে দীর্ঘ সাপ্লাই চেইনের মধ্যে বিরাজমান নানা স্টেকহোল্ডার এবং তাদের নানামুখি ভূমিকা আড়াল হয়ে যায়। এই বিশ্লেষণ গুলো আমাদের শ্রমিক রাজনীতির এবং শ্রমিককে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে জরুরী হয়ে পড়েছে। আমার মনে হয় এই অতিমারীর পরিস্থিতি একটি সুযোগ এই প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাববার। আমরা ভাবতে পারি কিভাবে শ্রমিক রাজনীতিকে আরো ক্রিয়েটিভ ভাবে ভাবা যায় সে বিষয়ে। আমরা সবাই জানি কারখানা একটি অসম শ্রম সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কাজ করে, যা আমরা বললেই পাল্টে দিতে পারব না। এই অসম শ্রম সম্পর্কের মধ্যেও শ্রমিকের জন্য একটি ন্যায্য দরকষাকষির ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরী, এবং এমন শ্রমিক সংগঠনও জরুরী যারা শ্রমিকের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে এবং আস্থার সম্পর্ককের মধ্য দিয়ে কাজ করতে পারে।
[লেখার শিরোনাম তরুণ গার্মেন্টস শ্রমিকের কারখানার ভিতর থেকে করা লাইভ ভিডিও’র বক্তব্য থেকে নেয়া।]
নাজনীন শিফা একজন গবেষক। বর্তমানে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় পি এইচ ডি করছেন।