কাজী তাফসিন
মহামারী নিয়ে আমার দেখা প্রথম হলিউডি ঘরানার চলচ্চিত্র ছিলো ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড (২০১৩)। মুভিটা ২০১৩ সালে মুক্তি পেলেও আমি তখনই সেটা দেখতে পারিনি। সম্ভবত এর কিছুদিন পর এইচবিও টিভি চ্যানেলে মুভিটা দেখায়। একদিন রাতের খাবার খাওয়ার সময় টিভির চ্যানেল পরিবর্তন করার সময় মুভিটা চোখের সামনে এসে পড়ায় দেখা শুরু করি। দেখা শুরু করার পর প্রথমে একেবারেই বুঝতে পারিনি এই মুভির প্লটটা ঠিক কিসের ওপর বানানো। মুভিটা একেবারে প্রথম দৃশ্য থেকে না দেখার কারণে এমনটা মনে হয়েছিলো কিনা জানি না। তবে প্রথমদিকে দেখে মনে হচ্ছিলো এটা হয়তো জম্বি ঘরানার কোনো হলিউডি মুভি, যেখানে কিনা ভুতুড়ে এই জম্বিগুলোকে ব্রাশফায়ার করে সাফ করার কাজটা ছবিতে ফুটিয়ে ওঠানোই ছিলো গল্পের মূল উদ্দেশ্য।
কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারি যে এটা শুধুমাত্র কোনো জম্বি ঘরানার চলতি মুভি না। বরং মুভিটার মূল প্লট বা কাহিনীটা সাজানো হয়েছে মহামারীর ওপর। যেখানে এই মহামারীতে আক্রান্ত হবার পরপরই সাথে সাথে যেকোনো একটা সুস্থ মানুষ পরিণত হয় জম্বিতে। আর একইসাথে একজন জম্বি যখন আরেকজন সুস্থ ব্যক্তির সংস্পর্শে আসে সাথে সাথেই সংস্পর্শে আসা অপর সুস্থ ব্যক্তিটিও জম্বিতে পরিণত হয়ে যায় সংস্পর্শের এগারো সেকেন্ডের মধ্যেই। এভাবেই মুভিতে দেখানো হচ্ছিলো যে, ক্রমাগত জম্বিতে একাকার হয়ে যায় একেকটা রাষ্ট্র কিংবা জনপদ। কিন্তু শুধুমাত্র দুয়েকটা দেশ এই রোগ থেকে কিছুটা রক্ষা পায় তাদের সীমানাবর্তী (territory অর্থে) জায়গাগুলোতে বিশালাকারের প্রাচীর নির্মানের কারণে, যেটা তাদেরকে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ‘জম্বি নাগরিকদের থেকে রক্ষা করে।
মুভিতে এরকম একটা দৃশ্য ছিলো যে ‘প্যালেস্টাইনের’ রোগাক্রান্ত জম্বিরা বর্তমান ইসরাইলের প্রাচীর টপকে ‘ইসরাইলের পবিত্রভূমিতে’ অতর্কিতে ঢুকে পড়েছে দিনের বেলাতেই, ঝাঁপ দিচ্ছে জেরুজালেমের অভ্যন্তরে। আর তখন ইসরাইলি সেনারা তাদের নিজ রাষ্ট্রের নাগরিকদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে [স্ক্রিনশটগুলো ঐ মুহূর্তেটাকেই তুলে ধরছে]। এভাবে সীমানার ওপারে থাকা মহামারীতে আক্রান্ত জম্বিদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে ব্রাশফায়ার করাকে একরকম বৈধতা দিয়ে প্রাণপণ লড়াই করার দৃশ্যগুলো প্রত্যক্ষ করে যাচ্ছিলেন নায়ক জেরি (অভিনেতা ব্র্যাড পিট)।
এখানে নায়ক পেশায় একজন জতিসংঘের সাবেক যুদ্ধ পরিদর্শক বা War investigator। নায়কের চরিত্রের মূল কাজ হলো, সারা বিশ্বব্যাপী মহামারীতে আক্রান্ত জম্বিরা যে ‘নৈরাজ্য’ শুরু করেছিলো তা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে পরিদর্শন করা এবং ভ্যাক্সিন আবিষ্কারে সাহায্য করার মাধ্যমে মানবতাকে ‘World War Z’ নামে এই মহামারীর বিরুদ্ধে ঘোষণা দেয়া যুদ্ধে জিততে সাহায্য করা। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত নায়ক জেরি লেইন কানাডার একটা দ্বীপে অবস্থিত ডব্লিউ এইচ ও’র একটা সেইফ জোনে (বা সংরক্ষিত এলাকায়) গিয়ে ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের সাহায্য করার মাধ্যমে বিজ্ঞানীদেরকে সহায়তা করে এবং এর মাধ্যমে সেই মহামারী থেকে একরকম উদ্ধার করে মুভির সমাপ্তি হয়। অর্থাৎ, মুভিতে শেষমেশ ‘মানবতা’ একরকম উদ্ধার পায় সেই অসুস্থ জম্বিদের হাত থেকে এবং মহামারী নামক এই সংকটের বিরুদ্ধে জারি করা ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড’ নামের এই যুদ্ধে জয় শেষে একরকম শান্তি নেমে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয় সিনেমাটিক মানবতার ওই পৃথিবীতে।
এই মুভিটা যখন প্রথম দেখি তখন কলেজে পড়তাম। মোটেই খারাপ লাগেনি সিনেমাটা দেখতে। যতদূর মনে পড়ে বেশ থ্রিলিং-ই লাগছিলো সে দৃশ্যগুলো দেখে- যখন সৈনিকদেরকে নির্বিচারে গুলি ছুড়তে দেখছিলাম ‘অসুস্থ জম্বিগুলোর’ দিকে অস্ত্র তাক করে। কিছুদিন আগে দ্বিতীয়বারের মত এই মুভিটা আবারো টরেন্ট থেকে নামিয়ে দেখছিলাম। কিন্তু এখন, এই বর্তমানে বসে মুভিটার কথা আবারো ভাবলে কিংবা আবারো দেখলে আর মোটেই আগের মত ‘থ্রিলিং’ কিছুই অনুভব করতে পারলাম না কেনো জানি। তাই ভাবলাম World War Z (২০১৩) মুভিটা দ্বিতীয়বারের মত আবার দেখার পর এই খটকা লাগার কারণগুলো কী হতে পারে- সেটা নিয়েই লিখি।
মহামারী নাকি জম্বি মুভির প্লট?
World War Z সিনেমার দুইটা বিষয় নিয়ে এই কোভিডের সংকটকালের মুহূর্তে আলোচনা করা জরুরি বলে মনে হয়েছে। প্রথমত এটা লক্ষ্য করার মত বিষয় যে, মহামারীতে আক্রান্ত মানুষকে কিভাবে সিনামের পর্দায় একেকটা ‘জম্বি’ হিসেবে উপস্থাপন করে সংকট সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছে এই সিনেমাতে। আবার একইসাথে ভাইরাসজনিত মহামারীর সমাধান হিসেবে কিভাবে নিজেদেরকে রক্ষার জন্য সিনেমাটায় রাষ্ট্রগুলো নিজেদের চারপাশেই বিশাল থেকে বিশালাকারের দেয়াল তোলার বিষয়টাকে জায়েজ করছিলো সেটাও লক্ষ্য করার মত। এইযে কোনো কিছু থেকে রক্ষা পাবার জন্য হুটহাট নিজের (পড়ুন self)– অর্থাৎ নিজ জাতি, জাতিরাষ্ট্র, নিজ ভূমি কিংবা জনপদ, পরিবার বা ব্যক্তি নিজের- চারপাশে সীমানাপ্রাচীর গড়ে তোলার পুরোনো অভ্যাসটা নিঃসন্দেহে সমস্যাজনক বলে মনে হয় আমার কাছে। অর্থাৎ, এককথায় যে কোনো সংকট মোকাবেলার ক্ষেত্রে নিজের চারপাশে দেয়াল তুলে অপরকে (Otherকে) ‘জম্বি’ বানানোর ঢংটাকে আমি সরাসরি জেনোফোবিক না বললেও অবশ্যই মহামারী এবং মহামারীতে আক্রান্ত রোগের সমস্যাজনক উপস্থাপনের একটা ইংগিত বলেই মনে করি- যেই সমস্যাটার অস্থিত্ব আমরা টের পেতে পারি এখনকার সময়ে আমাদের চারপাশের করোনায় আক্রান্ত বা অনাক্রান্ত ডাক্তার, প্রতিবেশীসহ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষদেরকে কিভাবে আমরা আলাদা করে দিতে দেখছি সেটা লক্ষ্য করলেই।
কিন্তু শুধুমাত্র এই ‘দেয়াল তুলে মহামারীর সমাধান করার চেষ্টা’র বিষয়টাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্যই আমি এই লেখাটা লিখতে বসিনি। আগেই বলেছিলাম যে এই মুভির উপস্থাপনের রাজনীতি নিয়ে আমার আলোচনার বিষয় মোটাদাগে দুইটা। প্রথমটা হচ্ছে, ‘মহামারী ঠেকানোর জম্বিতত্ত্ব’ হাজির করে মানুষের মধ্যকার সীমানাপ্রাচীর বাড়িয়ে তোলার আবশ্যিকতা সিনেমার মাধ্যমে তৈরি করবার ঢংটার সমস্যা। দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে একটা এপ্রায়োরা বা সিদ্ধান্তের ওপর মুভির প্লটটার দাঁড়িয়ে থাকার সমস্যা। আমি মনে করি এই সিদ্ধান্তের ওপর আমরাও এই মুহূর্তেও দাঁড়িয়ে আছি- যা সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক জায়গা থেকে আলোচনার দাবী রাখে। আমার সাথে হয়তো অনেকেই একমত হবেন কিংবা হবেন না। এখানে যে সিদ্ধান্তটা নিয়ে আমি কথা বলতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে, যেকোনো সংকটকে ‘যুদ্ধের অনুকল্প’ হিসেবে হাজির করে তার সমাধান করতে চাইবার প্রবণতা। মুভির নামকরন আর প্লট দেখলেই দর্শকের এটা বুঝতে বাকি থাকার কথা না যে, ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড’ নামের মুভিতে দেখানো এই মহামারীকে একটা ‘যুদ্ধ’ হিসেবেই দাঁড় করানো হয়েছে, যে যুদ্ধে মানুষের একরকম ‘জয়’ হয়েছে ইমিউনিটি তৈরি হবার ভ্যাক্সিন আবিষ্কার ও নায়ক ব্র্যাড পিটের বদৌলতে সেটা উদ্ধারের মাধ্যমে। সিনেমার উপসংহারও অন্তত তা-ই বলে।
আলোচনার দ্বিতীয় বিষয়টা হচ্ছে, যে কোনো রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য হুটহাট ‘বৈশ্বিক যুদ্ধ’ ঘোষণার যে রাজনৈতিক ভঙ্গি (এটিচ্যুড/ঝোঁক অর্থে) এই সিনেমায় এবং বাস্তবে আমরা দেখি সেটা নিয়ে। এই বিষয়টা তখনই আরো ভালো মত ঠাওর করা যায় যখন আমি এইমুহূর্তে বিশ্বব্যাপি রাষ্ট্রগুলোকে কোভিড-১৯ নিয়ে বর্তমান সংকটকে ‘করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করতে দেখছি, যে সংকটের ফলে দুই লক্ষের বেশি মানুষ মৃত্যূবরণ করেছে। অরুন্ধতী রায়ও প্রায় একইভাবে বলছিলেন যে ভারতেও “যেসব আমলা এখন এই মহামারি নিয়ন্ত্রণে কাজ করছেন, তাঁরা সাধারণত যুদ্ধের কথা বলতেই ভালোবাসেন। [কোভিড-১৯ এর সংকট নিয়ে কথা বলার সময়] আমলারা রূপক অর্থে যুদ্ধকে ব্যবহার করেন না, আক্ষরিক অর্থেই যুদ্ধ করেন।” (i) কোনো একদিন একটা ভ্যাক্সিনের আবিষ্কারের পর বর্তমান এই যুদ্ধকালীন উপবাস থেকে সবাইকে মুক্তি দেয়ার মাধ্যমে সবাই ‘করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে’ জয়লাভ করবে- এমন আশাবাদটাও অনেকের কাছেই অমূলক না।
কিন্তু এতো কিছুর পরেও ‘করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামের এই আপাত ‘নিষ্পাপ’ রাজনৈতিক ঢংটাকে কেনো আমি প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাচ্ছি সেটা পরিষ্কার করা জরুরি। আগেই বলে রাখি, কোভিড-১৯ এর সংকট মোকাবেলার জন্য ‘করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা দেয়ার এই বৈশ্বিক (ও দেশীয়) রাজনৈতিক পদক্ষেপকে সমস্যায়িত করলে অনেকেই হয়তো আপত্তি জানাতে পারে। কারণ এর আগেও বেশ কয়েকটা প্যানডেমিকে মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলো যেগুলো থেকে কোনো না কোনোভাবে ‘উদ্ধার’ পাবার মাধ্যমে হয়তো আজকে আমরা এই জায়গায় এসে ‘পৌঁছেছি’। কিন্তু হুটহাট করে কোনকিছুকে ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ বা জেহাদ ঘোষণা করবার রাজনৈতিক ঝোঁকটাকে অকপটে স্বীকার করে নেয়ার মাধ্যমেও কিন্তু বেশ কিছু ঝামেলা শুরু হতে পারে। তবে এই ঝামেলাগুলো কী, সেটা আলোচনা করার জন্য আমি নৃবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ব্রুনো লাতুরের সাহায্য নিবো।
… এর বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’
লাতুর তার “War of the Worlds: What about Peace?”(2002) প্রবন্ধে জলবায়ু বিপর্যয় কোনো যুদ্ধের সূচনা করেছে কিনা সেটা নিয়ে আলোচনা করছিলেন। সেখানে আধুনিকদের হুটহাট করে যে কোনো সংকটকে ‘যুদ্ধ’ বলে চিহ্নিত করার ঝামেলা নিয়ে তিনি কথা বলছিলেন। দেখা যায় যে সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিকতা অনেক কিছুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও, আদতে এই ‘আধুনিকেরা’ কি আদৌ কোনো যুদ্ধে জড়ায় নাকি আধুনিকতা বারংবার ‘যুদ্ধ ঘোষণার’ দোহাই দেয় যেন নতুন ধরনের পুলিশি অবস্থা জারি রাখার মাধ্যমে স্বয়ং ‘আধুনিকতা’, ‘প্রগতি’ আর ‘উন্নয়ন’ নামের ধারণাগুলোকে অক্ষত রাখতে পারে- সেটা নিয়েই লাতুর তার সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন এই প্রবন্ধটায়।(ii)
নব্যউদারনীতিবাদ আসার পরপর যে কয়টা বৈশ্বিক যুদ্ধ আমি/আমরা দেখেছি সেগুলোর দিকে একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে ‘আধুনিকেরা’ কি সাম্প্রতিক সময়ে আদৌ কোনো যুদ্ধে জড়িয়েছিলো কিনা- যেটাকে সত্যিকার অর্থেই ‘যুদ্ধ’ বলা চলে। বিশ্বব্যাপী চলতে থাকা এই ‘যুদ্ধগুলোর’ প্রেক্ষাপট আলোচনা করলে হয়তো বিষয়টা আরো পরিষ্কার হতে পারে। বিশ্বব্যাপী একসময় যুদ্ধ চালানো হয়েছে/হচ্ছে ‘দারিদ্র্যের’ বিরুদ্ধে। বিশ্বব্যাপী আমরা ‘টেরোরিজমের’ বিরুদ্ধেও যুদ্ধ হতে দেখেছি, যেখানে ‘ওয়েপন অব মাস ডেস্ট্রাকশনের’ আবিষ্কার করে এক রাষ্ট্র আরেক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন চালিয়েছে। এসব ‘যুদ্ধে’ আমরা অনেককেই অনেকভাবে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। পশ্চিমের অনেক রাষ্ট্রকেই ৯০’র দশকের আগে আমরা এমনকি ‘কমিউনিজমের’ বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে দেখেছি। আবার আজকাল ‘জলবায়ু পরিবর্তন কি আদৌ সত্যি নাকি সত্যি না’ সেটা নিয়েও এখনো ক্লাইমেট ডিনায়ার ও তাদের প্রতিপক্ষের মধ্যে ‘ফ্যাক্টের যুদ্ধ’ হতে দেখেছি আমরা- যেটাকে অনেকেই Science War নাম দিয়েছে। লাতুর নিজেও প্রায় সময় এই শব্দটা ব্যবহার করেন।
এমনকি আমি নিজেও যে রাষ্ট্রের দাস হিসেবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি সেখানেও কিছুদিন আগে ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ হতে দেখেছি। ‘মাদকের’ বিরুদ্ধে এরকম নাটকীয় যুদ্ধ শুধুমাত্র এই রাষ্ট্রেই যে ঘটে তা নয়। বরং এটা কমবেশি বেশিরভাগ রাষ্ট্রেই ঘটেছে, যেটা চালিয়ে যাওয়ার নানান রকম রাজনৈতিক ফায়দা লুকিয়ে থাকে ক্ষমতাসীনদের মধ্যে- যেটা অনেক নৃবিজ্ঞানীদের কাজেই স্পষ্ট। এমনকি এই মুহূর্তেও সম্ভবত প্রেসিডেন্ট দুতের্তে তাঁর রাষ্ট্র ফিলিপিনে এখনো এরকম নাটকীয় যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। মানে এই করোনার সময়কালেও।(iii) আর ল্যাটিন দেশগুলোতে তো মাদকের বিরুদ্ধে এই ধাঁচের ‘যুদ্ধ’ অনেক দিন ধরেই চলছে, যেটা আমরা কয়েকটা হাল আমলের হলিউডি মুভি দেখলেও আন্দাজ করে নিতে পারি। এটা বাদেও ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনের সময় অনেকেই হয়তো এখানকার ক্ষমতাসীনদেরকে ‘গুজবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ করতে দেখেছে।
“Since September 2001, we go on dialing the same emergency number, 911, and rightly so, since we have entered a state of emergency. We look around frantically to understand why all that we feel is worth fighting for remains so fragile.” (Latour 2002)
অর্থাৎ বলা যায়, পুরো পৃথিবীর রাজনৈতিক পরিসর আদতে দখল করে রেখেছে এইরকম কিছু ছোট বড় যুদ্ধ- যেগুলো ইতোমধ্যেই আমাদের প্রতিদিনকার খবরের কাগজ দখল করে রাখছিলো। এজন্য আধুনিকদের প্রতিমুহূর্তে এরকম যুদ্ধ ঘোষণা করে শিঙায় ফুক দেবার (যেটাকে লাতুর clarion call বলছেন) সেই স্টাইলটার উদ্দেশ্য কি আদতে যুদ্ধ করা নাকি ‘আধুনিকতাকে’ যেকোনো মূল্যে টিকিয়ে রাখার মাধ্যমে পুলিশি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আরো বাড়িয়ে তোলা- সেটা নিয়েই লাতুর তুলনামূলক বেশি সন্দিহান। এই সন্দিহান হবার অবশ্য একটা তাত্ত্বিক কারণও আছে।(iv) [আমার মনে হয় লাতুরের আপত্তির পিছনে এই তাত্ত্বিক কারণটা নিঃসন্দেহে আগামবেনের জরুরি অবস্থা বিষয়ক আলোচনা থেকে ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে পারে অনেককেই]
ইদার ওয়ার অর ইট ইজে এ পিস মেকিং পোলিস অপারেশান!
“The word ‘war’ is spewing out of every mouth, and although it sounds so disheartening at first there might be an opportunity to seize on these clarion calls.” (Latour 2002)
“War of the Worlds: What about Peace?”(2002) গ্রন্থে লাতুর যখন আলোচনা করছিলেন জলবায়ু বিপর্যয় কীভাবে একটা নতুন যুদ্ধের মুখোমুখি এনে আমাদেরকে দাঁড় করাতে পারে, তখন তিনি এজন্যই আদতে যুদ্ধের সংজ্ঞা কী বা এর রূপ কী সেটা পুনরায় পরিষ্কার করে নিতে চাচ্ছিলেন। এই বিষয়গুলো পরিষ্কার করার জন্য তিনি সাহায্য নিয়েছিলেন দার্শনিক কার্ল স্মিটের রাজনৈতিক দর্শন থেকে। “কার্ল স্মিট মনে করেন, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ একমাত্র তখনই করা সম্ভব যখন দুইটা পরস্পরবিরোধী পক্ষের মধ্যে কোনো মধ্যস্থতাকারী রেফারি বা সমঝোতাকারী থাকবে না” (লাতুর ২০০২)।
সহজে বললে, পরস্পরবিরোধী দুই (বা ততোধিক) দলের ফুটবল খেলার মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত এরকম কোনো মধ্যস্থতাকারী রেফারি থাকবে যে কিনা সালিশের মাধ্যমে ঠিক করে দেবে কোন খেলোয়াড়েরা সঠিকভাবে খেলছে আর কে ভুলভাবে খেলছে; কোন খেলোয়াড়কে কখন লালকার্ড দেখানো হবে আর হবে না, তখন সেটাকে ‘যুদ্ধ’ বলা যায় না। অর্থাৎ যুদ্ধ হচ্ছে একরকম ফুটবল ম্যাচের মতন, যেখানে উভয়পক্ষের মেনে নেয়া কোনো কমন রেফারি (বা সালিশী মধ্যস্থতাকারী) থাকবে না। একমাত্র এই রেফারিবিহীন অবস্থাতেই যে কোনো স্বত্তার ‘রাজনৈতিক’(political) হয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত বিবাদমান এই দুইপক্ষের মধ্যে একজন মধ্যস্থতাকারী থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত সেই মধ্যস্থতাকারী তার অধীনে থাকা দুই পক্ষকেই রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় (depoliticize/neutralize) করে রাখবে।(v) তখন সেটাকে আর যুদ্ধ বলা যায় না, বরং সেটা হয় একটা পুলিশি নিয়ন্ত্রণের মামলা।
যেমন, জলবায়ু বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে ‘প্রকৃতি-সংস্কৃতির বিভাজন’ এই মধ্যস্থতাকারী রেফারির ভূমিকা পালন করছে, যেটা আমাদেরকে রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় করে রাখছে বলে লাতুর মনে করেন। তাই জলবায়ু বিপর্যয় একমাত্র তখনই একটা রাজনৈতিক যুদ্ধের বিষয় হয়ে উঠবে যখন আমরা এই ‘প্রকৃতি-সংস্কৃতি বিভাজন’ নামের রেফারির নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেদেরকে বের করে নিয়ে আসতে পারবো। সেদিক থেকে চিন্তা করলে, লাতুরের মতে, একমাত্র জলবায়ু বিপর্যয়ই মানুষের জন্য অপেক্ষা করা এমন একটা যুদ্ধ যেটা কিনা আধুনিকতাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেয়ার সামর্থ্য রাখে। এজন্যই লাতুর জলবায়ু বিপর্যয়কে তার এই গ্রন্থে ‘War of the Worlds’ হিসেবে দেখাতে চাচ্ছেন, যেটা শুধুমাত্র তখনই একটা ‘যুদ্ধ’ হিসেবে নিজেকে হাজির করতে পারবে যখন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন-সোচ্চার মানুষ ‘ন্যাচার-কালচার বাইনারি’র মত পুলিশি রেফারির নিয়ন্ত্রণ থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে পারবে।
এভাবেই লাতুর ‘যুদ্ধ’(War) এবং ‘শান্তি কায়েমের পুলিশি ব্যবস্থা’র (Peace making police operation) মধ্যে তফাত করে এই সন্দেহ প্রকাশ করছিলেন যে- আধুনিকেরা সাম্প্রতিক সময়ে কি আদৌ কোনো যুদ্ধে জড়িয়েছে নাকি বারবার যুদ্ধ থামিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ ঘোষণার দোহাই দিয়ে নিত্য নতুন পুলিশি ব্যবস্থা জারি করে রেখেছে? সেদিক থেকে ভাবলে, এই সময়ে চলতে থাকা ‘করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ’কেও কি আদৌ যুদ্ধ বলা যায় কি না সেই সন্দেহ তৈরি হয়, যেহেতু করোনা আসার পর ইতোমধ্যেই অনেক দেশেই একরকম পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম করা হয়েছে [আরো দেখুন]। অরুন্ধতী রায় যেমন বলছিলেন, ভারতে নাগরিকদেরকে রাস্তাঘাটে শাস্তি দেয়ার পসরা বসানো হয়েছে, ব্যাঙঝাঁপ দেয়ানো হচ্ছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদেরকেও কিছুদিন আগে নানা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আবার সেদিন দেখলাম, সিঙ্গাপুরে সামাজিক দূরত্ব রক্ষায় রাস্তায় মোতায়েন করার কথা ভাবা হচ্ছে বোস্টন ডায়নামিক্সের রোবট।(vi) যে বোস্টন ডায়নামিক্সের বিভিন্ন গবেষণা কাজের এথিক্স নিয়ে কয়েক বছর আগেও অনেক এক্টিভিস্ট বড় কতগুলো আপত্তি তুলেছিলেন এবং এখনো তুলে যাচ্ছেন।(vii)
সূত্রঃ সি এস এন (৮ই মে, ২০২০)
তাই বলাই যায়, আদতে যুদ্ধ করা নয় বরং আধুনিকতার ঘোষণা দেয়া এই যুদ্ধগুলো ছিলো যে কোনো মূল্যে গ্লোবালাইজেশন, প্রোডাকশন কিংবা উন্নয়নের জারি করা পুলিশি ব্যবস্থাকে জারি রাখার একেকটা প্রচেষ্টা- যেখানে কিনা ‘আধুনিকতা’কে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে প্রশ্নাতীত অবস্থায়। তাই করোনার মত একটা না-মানুষ এসে যখন পুরো পৃথিবীর প্রগতির টাইটানিকটাকে ধীরগতির করে দিলো, সেটাকে ঠাট্টাচ্ছলে উল্টো সম্মান-ই জানাতে বলছিলেন ব্রুনো লাতুর তার কোভিভ-১৯ সংকট নিয়ে লেখা ‘Is this a Dress Rehearsal?’ [লেখাটির বাংলা অনুবাদের জন্য দেখুন]শিরোনামের ব্লগ পোস্টে। কারণ আমরা অনেকেই এতোদিন যাবত বাকি সবকিছু বাদ দিয়ে অর্থনীতির অদৃশ্য হাতের ফ্যান্টাসিতে ডুবে ছিলাম, যে হাতের জন্ম আমরা নিজেরাই দিয়েছিলাম সতেরো-আঠারো শতকের কোনো একটা সময়ে। কিন্তু কোভিডের এই সংকট আমাদেরকে এমন অনেক কাজ করা থেকেই বিরত থাকার একটা সুযোগ করে দিতে পারে যেটা জলবায়ু বিপর্যয়ের সংকট মোকাবেলার একটা ‘পোশাকী মহড়া’ হিসেবে কাজ করার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। এটা হয়তো এমন এক সময় যখন কিনা ‘উন্নয়ন’ কিংবা ‘প্রগতি’র নামে পৃথিবীর বাদবাকি মানুষ কিংবা না-মানুষের ওপর চালানো ‘স্বাভাবিক’ জরুরি অবস্থার রাজনীতিকে অপ্রাসঙ্গিক করে অন্য কিছুতে মনোযোগ সরাতে আমাদেরকে বাধ্য করে। এই অবস্থা তৈরি না হলে হয়তো আমরা কখনো ঠাওরই করতে পারতাম না যে, বিকল্প কোনো রাস্তার কথা আদৌ ভাবার দরকার আছে নাকি নেই বা কখনোই হয়তো আমিও ঠাওর করতে পারতাম না যে, ওয়ার্ল্ড ওয়ার জেড মুভিটা কি আবারো দেখে নেয়ার প্রয়োজন আছে নাকি নেই।
সিনেমার জগতকে ‘ফ্যান্টাসি’ বলা আর সিনেমার বাইরের জগতকে ‘বাস্তব’ বলার ভঙ্গিটা আমার বরাবরই অমূলক বলে ঠেকে। আমার বরং মনে হয় আমরা ইতোমধ্যেই আধুনিকতার দাঁড় করানো ন্যাচার-কালচার বাইনারির তৈরি করা ‘বাস্তবের’ ফ্যান্টাসিতে বাস করছি। তাই লেখার শেষ অংশে আমার এই কাল্পনিক প্রশ্নটাকেও আমি উড়িয়ে দিতে চাই না যে, রুপক অর্থে World War ‘C’ [capital C for corona] নামের বর্তমান এই পরিস্থিতিটাও কি আদতে ‘World War Z’ সিনেমার ছায়াতে বসেই বিশ্রাম নিচ্ছে?
Photo courtesy: author
কাজী তাফসিন নৃবিজ্ঞানের স্নাতক, এখন মাস্টার্স করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। তত্ত্ব নিয়ে আগ্রহ, অনুবাদ করতে পছন্দ করেন।
টীকা
(i) অরুন্ধতী রায়ের এই লেখার বাংলা অনুবাদের লিংকটি সংযুক্ত করা হল।
(ii) লাতুর যখন আধুনিকতা নিয়ে আলোচনা করেন, তখন অনেকেরই মনে হতে পারে যে তিনি আধুনিকতা বিরোধী। কিন্তু লাতুর মনে করেন আধুনিকতার বিরোধীতা করাও স্বয়ং আধুনিকতারই একটা ঝোঁক। এই জন্য তিনি আধুনিকতা এবং আধুনিকতা-বিরোধীতা দুটোকেই একইসাথে মাড়িয়ে ন-আধুনিক(Non-modern) অবস্থান নেন।
(iii) এই করোনার সময়কালেও দুতের্তের ড্রাগ ওয়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে জানতে ক্লিক করুন।(লিংক)
(iv) লেখায় প্রায়শই ‘আধুনিকতা’ শব্দটি আসায় আধুনিকতা বা মডার্নিটি বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি সেটা পরিষ্কার করা প্রয়োজনীয়। আধুনিকতা নিয়ে অনেকেই ইতোমধ্যে কাজ করলেও আমি এখানে মূলত ব্রুনো লাতুরের কাজকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছি। লাতুর মনে করেন, আধুনিকতা হচ্ছে একধরনের অধিবিদ্যক চুক্তি (settlement) যেটা ‘প্রকৃতি’ এবং ‘সংস্কৃতিকে’ আলাদা দুটো মেরুতে বসিয়ে যেকোনো কিছুকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে। আর এভাবে কোনোকিছুকে ‘প্রকৃতি’ আর ‘সংস্কৃতিতে’ ভাগ করে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসার জন্য লাতুর সব কিছুকে ‘এক্টর’ বলেন তার এক্টর নেটওয়ার্ক থিওরিতে। এই বিষয়ে আরো জানতে হলে দেখতে পারেন লাতুরের Pandora’s Hope (1999) বইটি। এটা বাদে জলবায়ু বিপর্যয় নিয়ে লাতুরের অনেক লেখাপত্র থাকলেও সেগুলোর মধ্যে “War of the Worlds: What about Peace?”(2002) প্রবন্ধটি এই লেখায় সহায়ক হয়েছে।
(v) দেখুন, কার্ল স্মিটের “The Age of Neutralizations and Depoliticizations”(1929) লেখাটি।
(vi) এই বিষয়ে আরো জানতে সিএনএন এর লিংকটি সংযুক্ত হল।(লিংক)
(vii) বোস্টন ডায়নামিকস এবং ভার্জিনিয়া টেকের গবেষণা কাজের উদ্দেশ্য এবং অর্থায়নসহ নীতিগত অনেকগুলো বিষয় নিয়েই বিগত বছরগুলোতে প্রশ্ন তুলে আসছিলেন জোডি উইলিয়ামস নামের একজন এক্টিভিস্ট। এ বিষয়ে আরো আগ্রহ থাকলে সংযুক্ত ডকুফিল্মটি দেখে নিতে পারেন।(লিংক)