নভেরা হোসেন
এ শহর ধোঁয়ায় আকীর্ণ মেট্রোপলিটন
কতকাল আর পাহারা দেবে
যক্ষের ধনের মতো কীটের শরীর?
আষাঢ়ের ঘন কালো মেঘের আনাগোনা নেই আকাশে। সন্ধ্যার নৈঃসঙ্গ্যতায় দূর হতে ডেকে যায় সারসেরা। একটা দুটো বাস চলে যায়, আমিও যেতে থাকি নিসর্গ নামের বাসে চড়ে। শহর থেকে লোকালয়ে, নিঃশব্দ বনের পথে? বন, বৃক্ষরাজি তাদের সাথে দেখা হয় না অনেক কাল। কেমন করে হবে? তাদেরকে কেটেইতো আমাদের এই শহরের বাস। এ কনক্রিটের শহরে কোলাহলময় ব্যস্ততায় নীরবে বটবৃক্ষ ডানা মেলে ছাদের দেয়ালে। তার সবুজ কোরকের ভাজে লুকিয়ে থাকে ভিসুভিয়াসের সংরাগ। প্রকৃতি বলে আমার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিন্ন করে তুমি তৈরি করেছ সুউচ্চ স্ক্যাইস্ক্র্যাপার। কিন্তু কী অদ্ভূত নির্মমতা কাঁচঘেরা স্ক্যাইস্ক্র্যাপারের সেমিনার কক্ষে সাজিয়ে রেখেছ আমারই বনসাই-কে! জীব ও জড় জগতের সাথে যূথবদ্ধ মানুষ মেসোজোয়িক, প্লয়স্টোসিন কাল পেরিয়ে আজ সাইবার প্রযুক্তির যুগে। এখন মানুষেরা হাতে বানানো যানে চড়ে মহাকাশে ঘুরে বেড়ায়, রোবটের বানানো স্যান্ডউইচ খায়।
এই মানুষই নিসর্গের অংশ ছিল কোনো এক কালে; পাহাড়ের গুহায় চকমকি পাথরের আলো জ্বেলে বন্য পশুর হাত থেকে রেহাই পেত। আগুন জ্বেলে অন্যকে ভয় দেখিয়ে নিজের নিরাপত্তা সুরক্ষিত করতে গিয়ে মানুষ নিজেও আগুনকে ভয় পেতে শুরু করল। আগুন পূজা করল। আগুনকে দেবতা বানাল। আবার আগুনের উৎস হিসেবে সূর্যকে আরও বড় শক্তি মনে করতে লাগল। সূর্য দেবতার উপস্থিতি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা, ভারতের বিভিন্ন জাতির মধ্যে দেখা যায়। সূর্য কারো কারো টোটেম মানে গোত্রের চিহ্ন। সূর্য থেকে সেই গোত্রের মানুষের জন্ম এমনটা মনে করা হয়। এরকম আরো হাজার হাজার টোটেম আছে। প্রকৃতির কোনো প্রাণী বা জড়বস্তুকে গোত্রভিত্তিক সমাজগুলো গোত্রের টোটেম বানিয়ে পূজো করতে শুরু করে; তাকে ঘিরে বিশাল মূর্তি গড়ে, উৎসবের আয়োজন করে। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন প্রাণীকে গোত্রের দেবতা হিসাবে পূজা করা হয়। ইঁদুর, সাপ, বেজি, বাঘ, নেকড়ে , রাজহাঁস, ময়ূর, অশ্বত্থ বিল্ব, তুলসি গাজকে পূজা করা হয়।
প্রকৃতিকে বহু হাজার বছরের চর্চিত বিশ্বাস, ট্যাবু, আচার-এর মধ্যে দিয়ে দেখলে বোঝা যায় মানুষের সাথে তার সম্পর্ক কত নিবিড়; একজন কৃষক প্রকৃতিকে তার আপন বিজ্ঞানাগারের মতো বছরের পর বছর ধরে নিরীক্ষা করে আসছে। শিকারী ও সংগ্রহকারীরা নিসর্গের হাজারটা বৃক্ষ, লতা-গুল্মের মধ্য থেকে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর উপযোগী খাদ্য নির্বাচন করত। খাদ্যের সন্ধানে গাছ বেছে বেছে বের করত কোনটা ফলবান বৃক্ষ, কোনটা ওষধি, কোনটা বিষ। নারীরা বাচ্চা সামলাতে গিয়ে বা গর্ভাবস্থায় যখন ঘরে একটু বেশি সময় থাকতে শুরু করল তখন তাদের হাত দিয়েই কৃষি কাজের সূচনা। নারীকে কৃষিভিত্তিক সমাজে অনেক মর্যাদা দেয়া হয়; তাকে শস্য, ভাগ্য, শক্তির দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়। বাংলার দেবী দুর্গা দশভুজা, তার কাহিনী’র মধ্য দিয়ে অসুরকে বধ করার চিত্র আমরা দেখতে পাই। প্রকৃতির এই সব ক্রিয়াকর্মই কোনো জাতি, ধর্ম, গোত্রের মধ্যে প্রতিকী হিসাবে চলে আসে।
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী চাকমা, মারমা ও অন্য জাতির জীবনের সাথে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক দেখা যায়। চাকমা নারীরা খাড়া পাহাড় বেয়ে বাচ্চাদেরকে পিঠে বেঁধে নিয়ে জুম চাষ করতে যায়, সেখানে জুম ঘরে বাচ্চাদের রেখে তারা জমি তৈরি থেকে শুরু করে ফসল তোলা সব রকম কাজ করে। তাদের গান, কবিতা, উপকথাগুলো তৈরি হয় প্রকৃতিকে কেন্দ্র করে। পাহাড়ের বুকে কোনো ঝরনা বা দীঘি তৈরির সাথে জড়িয়ে থাকে তাদের জীবনের গল্প। সুন্দরবনের মৌয়ালরা মুখে কাপড় বেঁধে হাতে মশাল জ্বালিয়ে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে। মৌমাছিরা আবার সেখানে বাসা তৈরি করে, ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে, একটু একটু করে মধু জমিয়ে মৌচাক বানায়। নিসর্গ বা প্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষ পৃথিবীতে হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছে কিন্তু বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামো প্রকৃতির সাথে মানুষের সে সম্পর্ককে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। ভোগবাদী সমাজের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বনকে বন উজার হয়ে যাচ্ছে, জ্বালানী সংগ্রহের জন্য গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে ফলে বনের পশু-পাখি কীট-পতঙ্গ তাদের বসবাসস্থল হারাচ্ছে, ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে দুর্লভ প্রাণীকূল। টিকে থাকার জন্য প্রকৃতির ইকোলজিক্যাল ভারসাম্যতার প্রয়োজন ।
যখন একটি প্রাকৃতিক অঞ্চলের বৃক্ষ বা প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটে তখন প্রতিবেশগত ভারসাম্য ভেঙে পড়ে। পৃথিবীর হাজার হাজার প্রাণীর মতো মানুষও একটি প্রাণী তাকে প্রকৃতির সাথে অভিযোজন করে বাঁচতে হয় কিন্তু সে যদি নিজের ভোগ বিলাসের জন্য অথবা তথাকথিত সভ্যতাকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রাকৃতিক ভারসাম্যতাকে বাধাগ্রস্ত করে; একটা মৌমাছি, ইঁদুর, সাপ, ব্যাঙ, মাছের আবাসস্থল নষ্ট করে দেয়, গাছ কেটে জ্বালানী আর আসবাবের কাজে ব্যবহার করতে থাকে, বৃহৎ শিল্পের রাসায়নিক বর্জ্য ফেলে নদী-নালাকে দূষিত করে ফেলে তাহলে ধীরে ধীরে পৃথিবী মানুষসহ সকল প্রাণীর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে মরুকরণ শুরু হয়ে গেছে , গ্রীন হাউজ গ্যাসের প্রভাবে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করেছে, বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ-বন্যা, জলোচ্ছাস, ঝড়, খরা।
আজ বিশ্বজুড়ে করোনার প্রকোপ বাড়ার সাথে মেরুর বরফ -গলন এবং ভাইরাস -ব্যাক্টেরিয়ার বাগ তৈরির বিষয়টি সামনে চলে আসছে। যে জীবাণু হাজার হাজার বছর ধরে বরফে চাপা পড়ে ছিল তারা সব আজ বের হয়ে আসছে পৃথিবীর অতিরিক্ত উষ্ণতার জন্য। আমাদের যান্ত্রিক প্রযুক্তিকে এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে করে আমরা পৃথিবীকে আর উষ্ণ আর দূষিত না করি।
নভেরা হোসেন কবি ও লেখক। পড়াশুনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগে।