সায়েমা খাতুন

যৌনতাকে পাশ কাটিয়ে এর বাইরে নিয়ে কেবল সহিংসতা হিসেবে ধর্ষণকে বুঝতে যাওয়াটা অনেকে মুশকিলের মনে করেন। আমেরিকান নারীবাদের ভেতরে এটি তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। যৌনতার জায়গা থেকে ছিন্ন করে কেবল সহিংসতার জায়গায় স্থাপন করাটাকে মনিক প্লাজা, তেরেসা ডি লরেটিস প্রমুখ বিভ্রান্তিকর ও অগ্রহণযোগ্য মনে করেন। রেটোরিকের সহিংসতা, সহিংসতা কিভাবে পরিবেশন করা হয়, পরিবেশনের প্রক্রিয়ায় কীভাবে এই পরিবেশনই আবার সহিংসতাকে উস্কে দেয়, তার আলোচনায় লরেটিস যৌনতার জগতের সাথে সহিংসতাকে বোঝাবুঝির তর্ক-বিতর্কগুলোর প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। যেমন মনিক প্লাজা এভাবে বলেন যে, এটা হলো “আমাদের দাম চুকানো এবং তাদের সুবিধার” [“our costs and their benefits”] ব্যাপার। তিনি প্রশ্ন করেন যে, ধর্ষণ একটা যৌন অনুশীলন, যৌন সহিংসতা না হলে সেটা তবে কী ? যদি সম্পূর্ণ নারীর বিরুদ্ধে না-ও  ঘটে “ধর্ষণের সার হলো যৌনতা, কেননা এটি লিঙ্গীয় ভিন্নতার সামাজিক পৃথকীকরণের উপরই দাঁড়িয়ে থাকে … ধর্ষণে নিহিত থাকে সামাজিক যৌনতা। যদি পুরুষ নারীকে ধর্ষণ করে, এটা স্পষ্টত তারা সামাজিক অর্থে নারী বলেই।” [“rape is sexual essentially, because it rests on the very social difference between the sexes … It is social sexing which is latent in rape. If men rape women, it is precisely because they are women in a social sense.”] আর পুরুষ যখন ধর্ষিত হয়, সে-ও হয় নারীর মত এক অধস্তন দশায়।

সহিংসতা হিসেবে ব্যাখ্যার একটা চেষ্টা থেকে এ রকম করে বলা হয় যে, নারীরা অত্যাচারিত বা জুলুমের শিকার মাত্র (‘৭১ পরবর্তী নারী পুনর্বাসনকর্মী তাহেরা শফিক যাকে ‘টর্চার’ বলেছেন), অন্য কিছু নয়। ‘অন্যকিছু নয়’ বলতে ‘ইজ্জত যাওয়া’, ‘সম্ভ্রমহানি’র ধারণাকে খারিজ ও প্রত্যাখ্যান করবার কথা বোঝানো হয়েছে। যেমন, ২০১১ সালে নারীপক্ষের একটি ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘ইজ্জত-সম্ভ্রম কোনোভাবেই শরীরকেন্দ্রিক নয়, তাই ধর্ষণ ও যৌন-নির্যাতনের শিকার নারীদের ইজ্জত-সম্ভ্রমের প্রশ্ন তোলা তাঁদের মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুন্ন করার সামিল। … আমরা যারা বীরাঙ্গনা, আমাদের ইজ্জত যায়নি, সম্ভ্রমহানি হয়নি, আমরা শুধু যুদ্ধাপরাধের শিকার। এই স্বর উদার জাতীয়তাবাদীদের তুলনায় একেবার ভিন্ন। এই বিশ্লেষণ এসেছে গণধর্ষণের বিচার ও শাস্তির আইনগত বিবেচনা, নারীর সামাজিক নিগ্রহ নিরসন এবং বীরের সম্মান, মর্যাদাপূর্ণ জীবন-যাপনের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা ফিরিয়ে দেবার অ্যাক্টিভিস্টের ভাবনা থেকে।

কিন্তু যৌনতাকে বাতিল করে ধর্ষণকে আমরা সত্যি সত্যিই ‘কিছুই না, ‘তেমন কিছু না’ বলতে পারি কী? ‘ইজ্জত’-এর মতো এত সাংঘাতিক শক্তিশালী একটা মতাদর্শকে মোকাবেলা করবার সেটা কার্যকর রাস্তা হবে কী? ‘ইজ্জত’ যাওয়ার ধারণাটিই তো আসে যৌন নিপীড়নের বৃহত্তর প্রেক্ষাপট তথা পিতৃতন্ত্র থেকে। ‘ইজ্জত’-এর ধারণা বাতিল করতে গিয়ে আমি কাউকে কাউকে এমন বলতে শুনেছি যে, নারীর যৌনাঙ্গের ক্ষয়-ক্ষতি হাত-পা, চোখ-শরীরের যে কোন অঙ্গহানি কিংবা পুরুষের যৌনাঙ্গহানি (castration) থেকে আলাদা কিছু নয়। সুতরাং ধর্ষিত নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার মতোই । তাহলে প্রশ্ন হল: হাত-পা-চোখ দিয়ে বাচ্চার জন্ম দেয়া যায় কি? ব্যক্তিগত মালিকানার ব্যবস্থায় সামাজিক মানুষের আত্ম-পরিচয়ের মৌলিক প্রশ্ন হলো কার পেটে কার সন্তান। আত্ম-পরিচয়ের সীমা (identity boundary), নৈতিকতা ও সামাজিকতা রক্ষার সবচাইতে কঠিন এই প্রশ্ন। সামাজিক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষমতার ভরকেন্দ্র হলো সমাজের জৈব-সামাজিক পুনরুৎপাদন ব্যবন্থা (mode of reproduction) সোজা বাংলায় সন্তান জন্মের বিধিব্যবস্থা বা বংশসৃষ্টি । আমাদের সন্তান আসে, বড় হয়- এসব ঘটে ইতিমধ্যে তৈরি হওয়া একটি ইজ্জত ব্যবস্থার নৈতিক-সামাজিক- মতাদর্শিক পরিসরে। প্রতিপক্ষ ধর্ষণের অস্ত্র দিয়ে সেখানেই আঘাত করে মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়।

আমি মনে করি, ধর্ষণকে বুঝতে, যৌনতার ডিসকোর্সের বিশেষ গঠন এবং অনুশীলনের বিশ্লেষণ অত্যাবশক। কেউ কেউ – যেমন, ’৭১ পরবর্তী নারী পুনর্বাসন কর্মী তাহেরা শফিক দৃঢ়ভাবে মনে করেছেন, বাঙালি নারীরা যার মধ্য দিয়ে গেছে একে কেবল ধর্ষণ ও বাধ্যতামূলক বেশ্যাবৃত্তি বলে বর্ণনা করাটা ভ্রান্ত, অপর্যাপ্ত  শব্দমালা। তিনি ‘টর্চার’ শব্দটি অধিক গ্রহণযোগ্য মনে করেন।  ফুকো ধর্ষণকে অন্য যে কোন সহিংস কর্ম হিসেবে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন। তিনি মনে করেন, একে যৌনকর্মের চাইতে/যৌন অপরাধের বদলে আগ্রাসন-অত্যাচার-নির্যাতনেরই অঙ্গ হিসেবে যে কোনো সহিংসতার মত বিবেচনা করতে হবে (“Foucalt proposed that rape should be treated as an act of violence like any other, an act of agression rather than a sexual act.” [দেখুন, Teresa de Lauretis, The Violence of Rhetoric, On Representation and Gender in Roger N. Lancaster & Micaela Di Leonardo (eds.) The Gender and Sexuality Reader (New York: Routledge, 1998), p. 268|

ব্রাউনমিলারের মতো কিছু আমেরিকান নারীবাদীারাও একইভাবে ধর্ষণকে সহিংসতা বলতে আগ্রহী, তবে এর বিপরীত উদ্দেশ্যে -আইনি বিবেচনায়। তিনি বলেন: ” এটি একটি সহিংসতার অপরাধ এবং নারীর ওপর ক্ষমতা। “এটা একটা ত্রাস সৃষ্টির সচেতন প্রক্রিয়া, এর কমও নয়, বেশিও নয়, যা দিয়ে সব পুরুষ সব নারীকে ভীতিকর অবস্থায় রাখে। “অবনমনের ও ভাবী বিজেতার দখলদারিত্বের জন্যে একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, শত্রুতামূলক, সহিংস কর্ম এবং সন্ত্রস্ত রাখবার এবং ভয় জাগানোর প্রকল্প”। (“…a crime of violence and power over women”. “It is nothing more or less than a conscious process of intimidation, by which all men keep all women in a state of fear.” “…a deliberate, hostile, violent act of degradation and possession on the part of a would-be conqueror, designed to intimidate and inspire fear…” Against our will, 1974)। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধাবস্থায় নারীদেহ ব্যবহৃত হয় ‘এক্সট্রাকারিকুলার ব্যাটেলফিল্ড ((extra-curricular battle-field) হিসেবে। ধর্ষিত নারী নিজের সমাজের মানুষের কাছে  শত্র‌ুর পাশবিকতার সাক্ষর। “ড্যামেজড প্রপার্টি”  (damaged property) বা “নষ্ট সম্পত্তি”, অবাঞ্ছিত। তার জাতিকে পরাজিত করাবার  প্রতীক। পদদলিত জাতীয়  ও ধর্মীয় অহংকার। প্রোপাগান্ডা যুদ্ধের বাজির পণ।

কিন্তু যৌনতাকে বাদ দিয়ে কেবল সহিংসতা হিসেবে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নকে সত্যিকারভাবে বোঝা যায় কী? ২০২০ এর চলমান ধর্ষণ-প্রতিরোধ আন্দোলনের নোয়াখালি লং মার্চে পুলিশি হামলার সময়ও মার্চের নারীদের দেহের যৌন-সংবেদনশীল অংশে আঘাত করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের গণধর্ষণের পরে যখন দেখা যাচ্ছে, “মিলিটারী দিনে-রাইতে কয়বার ধর্ষণ করছে, বাঙালি জাতি এর হিসাব জানতে চায়। অন্যসব নির্যাতন তারা কখনো নির্যাতন মনে করে না”। বুটের লাথি, বেয়নেট চার্জ, সিগারেটের ছ্যাাঁকা- নারীর ওপর এমন বিচিত্ররকম নির্যাতন কেবল যৌন-লঙ্ঘনের সামাজিক গুরুত্বের কাছে হারিয়ে যায়। অন্য আঘাত সহ্য করা, বহন করা বীরত্বের, জাতীয় গৌরবের বিষয়,  যৌন-আঘাত পরম লজ্জা ও পরাজয়ের বিষয়, লুকিয়ে ফেলার বিষয়। শরীরে জখম- অত্যাচারের চিহ্ন মেডেলের মত প্রদর্শনের বিষয়, ধর্ষণ তার বিপরীত।

নারীর ক্ষেত্রে যে কোনো দমন-পীড়ন-নির্যাতন যে যৌনতার জগতে ক্রিয়া করে, নারী যে এক্সক্লুসিভ্লি (exclusively) যৌনভাবে নিপীড়িত হয়, পুরুষ মুক্তিযোদ্ধার উপর নির্যাতনে (যৌনাঙ্গহানি কিংবা বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি হলেও) যে ইজ্জত খোয়ানো ধর্ষণ আর তার লজ্জা- অপমান নেই, তার তাত্ত্বিক স্বীকৃতি জরুরি। না হলে, স্বাভাবিক শান্তিরর সময় নিয়মিত ঘটনা হিসেবে ধর্ষণকে কীভাবে বুঝব? ধর্ষণের পরিণতিতে “অবৈধ” গর্ভধারণকে কীভাবে বুঝব? “জারজ সন্তান” জন্ম দেয়ার গ্লানিকে কিভাবে বুঝব? কিভাবে বুঝবো, প্রতিদিন দেশে ১৩ জন নারী কেন ধর্ষিত হয় ? কীভাবে বুঝব যে, ধর্ষণ পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার ‘অর্ডার’ রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান বা এটি কটি বলপ্রয়োগ সংস্থা এবং যৌন অধস্তনতা কায়েম করে নারীকে ‘সিধা’ এবং ‘জায়গামত রাখবার এক অব্যর্থ কৌশল? যৌন প্রজননশীল প্রজাতি হিসেবে যৌন প্রজনন শক্তি ও যৌন চেতনার উপর, নারীর যৌন শক্তি ও মর্যাদার, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লঙ্ঘন করে বল প্রয়োগ, হামলা, আগ্রাসনকে রুখে দিতে যৌনতার নিয়ন্ত্রক ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। নিষ্ক্রিয় অধস্তন যৌন সত্তা থেকে সক্রিয় যৌন জীব হিসেবে নারীর যৌন ও প্রজনন শক্তির উপর আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মপ্রকাশ এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করার দীর্ঘ মেয়াদী সর্বাত্মক সংগ্রাম ছাড়া ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়ন বিলোপের আর কোন শর্টকাট পথ নেই। (১৯-২০  অক্টোবর ২০২০)

 

[মূল লেখাঃ মুক্তিযুদ্ধের His-story: ইজ্জত ও লজ্জা, ২০১৫ পাবলিক নৃবিজ্ঞান ২]

 

Image courtesy: authorসায়েমা খাতুন: সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

0 Shares

Leave A Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

2 × 3 =