২০০৮ সালে সাজেকে “রহস্যময়” আগুন লাগার পর গণতদন্ত কাজের জন্য সেখানে যাই। অন্তত দুটো স্বতন্ত্র দল ঢাকা থেকে গেছিল, যার একটাতে অন্যান্যদের মধ্যে মোশরেফা মিশু আর আমিও ছিলাম। যাবার পর, খাগড়াছড়িতে সন্ধ্যা নামার পরের উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক আর বিদ্যুৎহীনতার মধ্যে আমরা “বাঙালি” পর্যবেক্ষকরা রইলাম। আর অবশ্যই সারাবছর সেখানে থাকেন “অবাঙালি আদিবাসী”বৃন্দ।
পরদিন সকালে আমরা যখন ভয়াবহ সেই আগুনে নিশ্চিহ্ন গ্রাম দেখতে যাচ্ছি, পথের মধ্যেই সামনে পিছনে সেনাবাহিনীর গাড়ি পাওয়া গেল। যেরকম আপ্যায়ন করে তাঁরা আমাদের সেনা ক্যাম্পে নিয়ে গেলেন, সেটাকে বন্দিদশা বলে প্রমাণ করা মুস্কিল। কিন্তু নিজেদের বন্দি ভাবা ছাড়া আমাদের বিশেষ উপায় ছিল না। কয়েকজন সৈনিক ক্যাম্পের ভিতরে আমাদের আধাভাঙা শকটটি থেকে নামিয়ে, হাঁটিয়ে গার্ড অব ‘অনর’ দিতে দিতে একটা ছাউনিতে বসালেন। চারপাশে তার মনোরম সবুজ। যদিও তার আগের ২০-২৫ বছর ধরে “সন্ত্রাসবাদী”দের “ধরবার” জন্য, সেনাবাহিনী লাগাতার পাহাড়ি এলাকার বনাঞ্চল সাফ করে ফেলেছিল, তথাপি সেসব গাছ ছাড়াও সবুজ ছিল। একজন ঊর্ধ্বতন, ওই ক্যাম্পের দায়িত্ব নির্বাহী কর্নেল, আমাদের ১০-১২ জনের সঙ্গে মিহিমধুর হাসিতে কথাই কেবল বললেন না, উপরন্তু আমাদের দুপুরের খাবার খেতেও বাধ্য করলেন।
প্রাথমিকভাবে সৈনিকেরা আমাদের নিয়ে এলেও, দীর্ঘ আপ্যায়নের সংলাপ পর্বটি কেবল ক্যাম্পের দায়িত্বরত কর্নেল করছিলেন। কিছুক্ষণ পরপর “দৃষ্কৃতিকারী” অজ্ঞাত পার্বত্যবাসীদের গালমন্দ করা ছাড়া, তিনি পুরোটা সময় ছিলেন এক গাল হাসির এক মানুষ। ৮০’র দশকের খিটখিটা, লাগাতার সিভিলিয়ানদের অপমান করতে-থাকা কোনো অফিসারের ইমেজ এটা নয়। এটা নয়া ইমেজ। তিনি আমাদের “আশ্বস্ত” করলেন যে ঘটনাস্থলেও আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে, অবশ্যই বাধ্যতামলূক দুপুরখানার পর; এবং অবশ্যই তাঁর অফিসারদের “তত্ত্বাবধানে”, পাছে ‘দুষ্কৃতিকারী’ পাহাড়িদের হাতে আমরা নিগৃহীত না হই। আমাদের জানমালের “হিফাজত” যে তখন তাঁদেরই হাতে, সেটা আস্থার সঙ্গে ঘোষণা দিলেন। মিশু ও আমি এর মধ্যে এই আপ্যায়নপর্বে কয়েকবার পরস্পরের দিকে তাকালাম। সুযোগ পেয়ে দুয়েকবার নিচু স্বরে হুশ হুশ করে কথাও বললাম। আমাদের সঙ্গে-থাকা পার্বত্য বন্ধুগণ সেই “দুষ্কৃতিকারী” পার্বত্যবাসীদের প্রতিনিধি হিসাবে নিরুপায় বসে রইলেন।
মিষ্টি হাসির কর্নেল আমাদের মনে করিয়ে দিলেন: “আপনারা সেনাবাহিনীকে ভুল চোখে দেখেন। দেখুন এটা তো আর পাকিস্তানের মিলিটারি নয়। এটা বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। আমাদের জনগণের বন্ধু আমরা। পাহাড়ি জনগণকেও আমরাই রক্ষা করি।” আমরা বুঝলাম সাজেকের আগুনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বিষয়ে যেসব জনরব ছিল, সেটার একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। আর দিচ্ছেন ‘শীতল হুমকি’। সঠিক সুযোগ পেলে পার্বত্য এলাকাকে সুইজারল্যান্ড বানিয়ে দেখাবেন এই প্রত্যয় ঘোষণা করতেও সেনা কর্মকর্তা ভোলেননি। সুইজারল্যান্ডের বরফের ব্যবস্থা কীভাবে হবে সেই ভেবে ওরকম কড়া “আপ্যায়নের” মধ্যেও আমার খানিক হাসি-পাবার কথা আমি মনে করতে পারি। এই “হাসি”, আপনারা জানেন, অক্ষমের ক্রুদ্ধ পরিহাস।
তো সেই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী তার পরে, এবং আগেও বহুবছর, লাগাতার পার্বত্য এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করে চলেছেন। বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে গিয়ে বাংলাদেশের বাণিজ্যের সিংহভাগ দায়িত্বই তাঁদের নিজেদের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে। বলাই বাহুল্য, তাঁদের কাঁধে না-চাপলে আমলাদের কাঁধে চেপে পর্যটন-বাণিজ্য মুখ থুবড়েই পড়ত। এবারে সেনাবাহিনী চিম্বুক পাহাড়ে পাঁচ তারকা হোটেল বানিয়ে ফেলতে যাচ্ছেন। অবশ্যই ম্রো জনগণকে উচ্ছেদ হতে পারে তার জন্য! দেশের উন্নতির জন্য এরকম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়! কারো না কারো!
বাংলাদেশে হাজারকোটি টাকা চুরি-করা রাজনীতিক আছে, পার্বত্য অঞ্চলের বৃক্ষ নিধনকারী ও রিসর্ট স্থাপনকারী, বাণিজ্যে নিরঙ্কুশ মনোনিবেশকারী সেনাবাহিনী আছে। মাল্টিপল চয়েসে দুইটাই মাত্র যখন আছে, তখন জনগণের ঘুম পাওয়া অস্বাভাবিক নয়। আদিবাসী মরুক, কিংবা গরিব বাঙালি!! উন্নতি আমাদের হবেই, সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে!
(১০ নভেম্বর ২০২০। ঢাকা।। প্রাথমিকভাবে ফেসবুকের স্ট্যাটাস হিসাবে প্রকাশিত)