রাশীদ মাহমুদ
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে শিক্ষকতা ও গবেষণারত নৃবিজ্ঞানী ডেভিড গ্রেবারের “আজাইরা কাজ” বইটা প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। এতদিন তেমন মনোযোগ না দিলেও, এই লকডাউনে বইটা বেশ কিছু প্রশ্নের সামনে এনে নিজেকে হাজির করেছে। এতকাল আমরা কি কি প্রকারে প্রকৃতির ক্ষতি করেছি তা নিয়ে দেখলাম প্রায় সবাই ভাবিত। মোটামুটি সবাই এর পেছনে আমাদের অসংযত বেহিসেবি জীবন-যাপনকে চিহ্নিত করেছেন। “অসংযত বেহিসেবির” সহজ মানে তো জীবন চালানোর জন্য আমাদের যা দরকার তার চেয়ে “অতিরিক্ত” কিছু যেগুলো ছাড়াও আমাদের জীবন সুন্দরভাবেই চলে। লকডাউন ইতোমধ্যে আমাদের জীবনের নানা “অতিরিক্ত”, “আজাইরা” প্রয়োজন চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু, আমাদের যার যার পেশাগত কাজ কতটুকু প্রয়োজনীয় আর কতটুকু আজাইরা সেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে আমাদের বেশ অস্বস্তি রয়েছে। বাজারের দেয়া পেশাগত পরিচয় ছাড়া যেখানে আমরা নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাইনা, সেখানে বাজারপ্রদত্ত সেই পরিচয়কে প্রশ্ন করা প্রকারান্তরে আমাদের কাছে আত্মঘাতের শামিল।
সদ্য প্রয়াত নৃবিজ্ঞানী গ্রেবার। ছবি: ইন্টারনেট

গ্রেবার বাজারের দেয়া পেশাগত কিছু কাজকে এই “আজাইরা” বা আমার ভাষায় “অতিরিক্ত” ধারণার আলোকে একটু ঘেঁটে দেখেছেন। গ্রেবার মূলতঃ ৫ ধরনের কাজকে “আজাইরা” কাজ বলেছেন। একঃ হুঁকোবরদার (Flunkies)। এরা আপনার জন্য এমন সব কাজ করে যা আপনি নিজেই করতে পারেন। কিন্তু আপনি এদের পোষেন নিজেকে আজাইরা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করার জন্য। যেমন, দরজা খুলে দেয়ার লোক, লিফ্টম্যান, অভ্যর্থনাকারী ইত্যাদি। এক্ষেত্রে আমরা রাজনীতিবিদদের পেছন, পেছন ঘুরে বেড়ানো “সহমত” ভাই-বোনদের কথাও বলতে পারি। দুইঃ পান্ডা (Goons)। এদের আপনার দরকার শুধুই এই কারণে যে অন্যদেরও “পান্ডা” আছে। যেমন, লবিস্ট, জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ, টেলিমার্কেটিয়ার, কর্পোরেট আইনজীবী, সেনাবাহিনী, দেহরক্ষী ইত্যাদি। তিনঃ বুধো (Duct tapers)। এদের রাখা হয় অপদার্থ বড়োসাহেবদের আজাইরা ভুলের দায় কাঁধে নিতে। অর্থাৎ, উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে। চারঃ অনুমোদনকারী (Box tickers)। যেমন, মান নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা, Ranking কর্মকর্তা । পাঁচঃ পরিদর্শক, তত্ত্বাবধায়ক (Taskmasters)। এরা হুদাই প্যাঁচায়া, প্যাঁচায়া মানুষের খুঁত ধরে আর কাজ বাড়ায়। এই পুরো ব্যবস্থাটিকে গ্রেবার নাম দিয়েছেন “ব্যবস্থাপনার জমিদারী” (Managerial Feudalism)। গ্রেবার কেন এই পাঁচ ধরনের পেশাকে আজাইরা বলেছেন সেই বিস্তারিত এখানে নয়।

তবে আজাইরা পেশা চিহ্নিত করার বেলায় গ্রেবার খানিকটা কৌশলী ছিলেন বলা যায়। কারণ, এতো পেশার ভীড়ে তিনি নিজ পেশাকে সরাসরি টেনে আনেননি। তবে একটি জায়গায় তিনি পরোক্ষভাবে বলছেনঃ “আজাইরা কাজ করে এমন বিশাল একদল বেতনভোগী পেশাজীবী রয়েছে। এদের সাথে আপনার যদি কোন পার্টিতে দেখা হয় আর আপনি যদি এদের বলেন যে মহাশয় আপনি তো খুব কাজের কাজ করেন (যেমন ধরুন, একজন নৃবিজ্ঞানী), এরা এদের কাজ আপনার সাথে আলোচনাই করতে চাইবে না। কিছু মদ্যপানীয় গিলিয়ে দিয়ে এদের হালকা চড়িয়ে দিন। দেখবেন এরা নিজেরাই গড়গড় করে বলতে শুরু করবে যে এদের কাজ কতটা আজাইরা ও অর্থহীন”(গ্রেবার ২০১৮:৯)।

গ্রেবার কৌশলী হয়েছেন বোধহয় নিজের পূর্বঅভিজ্ঞতার আলোকে। প্রতিষ্ঠান ও প্রথা বিরোধিতার কারণে ২০০৬ সালে তাকে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারির চাকরিটা হারাতে হয়। এমনকি গ্রেবার যাতে আর কখনো ইয়েলের নৃবিজ্ঞান বিভাগে নিয়োগ পেতে না পারেন সে কারণে ইয়েলের নৃবিজ্ঞান বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ অনুরোধ করে বিভাগীয় পুনঃনিয়োগ নীতিমালাতেও পরিবর্তন নিয়ে আসে (গ্রেবার ২০১৮:১৯০)।

তবে এ ব্যাপারে বেশ খোলাখুলিই বলেছেন মার্কিন মুল্লুকের এক ইতিহাসের অধ্যাপক ক্রিস রাইট। Bullshit Jobs গ্রন্থের পর্যালোচনামূলক একটি লেখায় তিনি দাবি করছেনঃ One huge area of bullshit it leaves out he doesn’t mention at all: bullshit academic research. Surely the large majority of academic research makes essentially no contribution to the world, except to pad CVs and advance careers. Endless conferences, “calls for papers” sent out for yet another conference, thousands upon thousands of scholarly articles published every year most of which are read by hardly anyone (more often simply glanced over)।

যাই হোক, একবার ভাবুনতো আমাদের অধিকাংশ আজাইরা কাজের (বলায়, চলায়, পোশাকে, খাওয়ায়, গানে, নাচে, খেলায়, আসবাবে, তৈজসপত্রে, পরিবহণে, লেখায়, পড়ায়, ঘোরায়) উদ্দেশ্য কি নিজেকে কেউকেটা প্রমান করা নয়? অনেকেই হয়তো বলবেন এর মধ্যে লেখা-পড়াকে টেনে আনা কেন বাপু? উত্তরে আমি নিজে কিছু বলবোনা। শরৎচন্দ্রের “পন্ডিতমশাই” উপন্যাসে বৃন্দাবন ও কেশবের আলাপচারিতার আশ্রয় নেবো। কেশব বৃন্দাবনকে বলেঃ “কিসে ভালো হয়, না হয়, শিক্ষার গুণে আমরা বেশি বুঝি; তোমরাও চোখে দেখতে পাচ্চ, আমরাই সব বিষয়ে উন্নত, তখন তোমাদের কর্তব্য আমাদের কথা শোনা”। জবাবে বৃন্দাবন বললোঃ “দেখ কেশব, তোমরা আত্মীয়ের মত আমাদের শুভকামনা কর না, মনিবের মতো কর।….তোমাদের সংস্রবে লেখাপড়া শিখলে চাষার ছেলে যে বাবু হয়ে যায়, তখন অশিক্ষিত বাপ্-দাদাকে মানে না, শ্রদ্ধা করে না, বিদ্যাশিক্ষার এই শেষ পরিণতির আশংকা আমরা তোমাদের আচরণেই শিখি। কেশব, আগে আমাদের অর্থাৎ এই দেশের ছোটলোকদের আত্মীয় হতে শেখো, তার পরে তাদের মঙ্গলকামনা করো, তাদের ছেলেপিলেদের লেখাপড়া শেখাতে যেয়ো। আগে নিজেদের আচার-ব্যবহারে দেখাও, তোমরা লেখা-পড়া শেখা”। (চট্টোপাধ্যায় [১৯১৬] ২০১৭:৬৫)

এই বঙ্গে বিদ্যাশিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য যে কেবলই নিজেকে “ভদ্রলোক” প্রমাণ করা সে কথা বহু আগেই পন্ডিত ব্রুমফিল্ড ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত তার Elite Conflict in a Plural Society: Twentieth-Century Bengal গ্রন্থে বলে গেছেন। মাক্সিম গোর্কির “পৃথিবীর পাঠশালায়” উপন্যাসে দেখা যায় যে গোর্কি ক্রাস্নোভিদাভো গ্রামে থাকার সময় রমাস নামক একজন তাকে উপদেশ দিচ্ছেনঃ “শুধু দরকার পড়াশোনার – তবে এমন পড়াশোনা নয় যার ফলে আপনি আর আপনার আশেপাশের মানুষদের মাঝখানে কেতাবটাই একটা ব্যবধান হয়ে দাঁড়ায়” (গোর্কি ১৯২৩: ১১৮)। শরৎচন্দ্রের বৃন্দাবনের সাথে রমাসের সুর কোথায় যেন মিলে যায়।

অর্থাৎ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা লেখা-পড়াকে আশ্রয় করেছি নিজেদের “জমিদার” প্রমাণ করতে। কিন্তু, ভাই জমিদার হওয়ার অন্যতম গোপন শর্ত হচ্ছে “অবসর”। আর সেক্ষেত্রে জমিদার তো হচ্ছে ১৯৭২ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী জার্মান লেখক হেইনরিখ বল এর ছোটগল্পের (ঈষৎ পরিবর্তিত ও বিভিন্ন সংস্করণ মিশ্রিত) সেই জেলে। জেলের সাথে নদীর পাড়ে এক ধনী টুরিস্টের দেখা। টুরিস্ট তাকে বললো “তুমি এত অল্প সময় ধরে মাছ ধরো কেন”? জেলে বললোঃ “এতেই আমার হয়ে যায়”। টুরিস্টঃ “তাহলে বাকি সময় কি করো”? জেলেঃ “সকালে মাছ ধরি, এরপর বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাই, ঘরের কাজ করি, বউকে নিয়ে দুপুরে হালকা ঘুমাই, সন্ধ্যায় পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়াই, হালকা ওয়াইন পান করি, বন্ধুদের সাথে গিটার বাজাই। আমার কিন্তু বেশ পরিপূর্ন ও ব্যস্ত জীবন, সাহেব”। টুরিস্ট তখন তাকে এক বিরাট বিজনেস আইডিয়া দিলো যে কি করে সে আরো বেশি সময় ধরে আরো বেশি মাছ ধরে, সেই মাছ মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে না বেঁচে নিজে শহরের বাজারে বেঁচে ধীরে ধীরে কোটিপতি হয়ে যেতে পারে। সব শুনে জেলে জিজ্ঞেস করেঃ “কোটিপতি হতে কত বছর লাগবে”? টুরিস্টঃ “তা প্রায় ২০/২৫ বছর”। জেলেঃ “তারপর”? টুরিস্টঃ “তারপর আর কি! অবসর। তখন তুমি সকালে একটু মাছ ধরলে, বাচ্চাদের সাথে সময় কাটালে, ঘরের কাজ করলে, বৌকে নিয়ে দুপুরে হালকা ঘুমালে, সন্ধ্যায় পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়ালে, ওয়াইন পান করলে, বন্ধুদের সাথে গিটার বাজালে”। জেলেঃ “মশাই, সেটাই তো আমি এখন করছি। খালি, খালি জীবনের ২০/২৫ বছর জলাঞ্জলি দেব কেন”? লক্ষ্য করুন, হেনরিখ বল গল্পটি লিখেছিলেন ১৯৬৩ সালের মে দিবস উপলক্ষে। শ্রমিক দিবসে তার পরামর্শঃ আজাইরা খাটুনি বাদ দাও।

দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল আমাদের আজাইরা কাজের দাসত্বের বিষয়টা বহু আগেই ধরতে পেরে ১৯৩২ সালে আমেরিকার Herper’s ম্যাগাজিনে In Praise of idleness (আলস্যের প্রশংসা) শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলেন। এই লেখায় উনি খুব মজা করে বলছেনঃ “আধুনিক কালে কাজ, কাজ করে পৃথিবীর প্রভূত ক্ষতি হয়ে গেছে। সুখ ও সমৃদ্ধির পথে একমাত্র উপায় হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে কাজ কমিয়ে নিয়ে আসা”(রাসেল ১৯৩২)। মার্কিন অর্থনীতিবিদ ও সমাজবিজ্ঞানী থর্স্টেন ভেবলেন এরও বহু আগে ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত The Theory of the Leisure Class গ্রন্থে দেখিয়েছেন কিভাবে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের খাটতে লাগিয়ে দিয়ে উঁচুতলার মানুষেরা তাদের ঠাঁটবাট প্রকাশ করে “অবসর” প্রদর্শনের মাধ্যমে।

আসুন ভাবি। আজাইরা কাজ, কাজ করে “ব্যবস্থাপনা জমিদারি”র দাসত্বে জীবন জেরবার করবো নাকি নিজের অবসর বাড়াবো? জানি, এই প্রস্তাবের বাস্তবায়ন প্রায় অসম্ভব। সেক্ষেত্রে একটা কাজ বোধহয় আমরা করতে পারি। আজাইরা কাজের গুণগান বন্ধ করতে পারি, নিজেদের কেউকেটা মনে করা থামাতে পারি।

 

তথ্যসূত্র:

গোর্কি, মাক্সিম ১৯২৩. পৃথিবীর পাঠশালায়। রথীন্দ্র সরকার (অনুঃ), মস্কো: ‘রাদুগা’ প্রকাশন।

চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র [১৯১৬] ২০১৭. পন্ডিতমশাই। কলকাতা: দে’জ পাবলিশিং।

Broomfield, J. H. 1968. Elite Conflict in a Plural Society: Twentieth-Century Bengal. Berkeley: Los Angeles.

Graeber, David 2018. Bullshit Jobs. UK: Simon & Schuster.

Russell, Bertrand 1932. In Praise of Idleness. Herper’s Magazine. October 1932 issue.

Veblen, Thorstein 1899. The Theory of the Leisure Class. New York: B. W. Huebsch.

Wright Chris n.d. On “Bullshit Jobs”. Available at: https://www.academia.edu/38754318/On_Bullshit_Jobs_by_David_Graeber

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক
রাশীদ মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক।
0 Shares

Leave A Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 × five =