মানস চৌধুরী
করোনার নতুন শিং দেখা দেয়া, এর ম্যুটেশনে পরিবর্তন আসা, ৭০ ভাগ সম্প্রসারণশীল করোনার আবির্ভাব ইত্যাদি বিষয়ে যে-যা বলেন তা শ্রদ্ধার সঙ্গে আমাদের মেনে নেয়া উচিত। যে-যা বলতে অবশ্যই বিজ্ঞানীদের কথা বলছি। দেশি, বিদেশি, বহুজাতিক, জাতিসংঘীয়, মহাগবেষণাগার যেখানকারই হোন না কেন, বিজ্ঞানীদের কথা আমাদের মেনে নেয়া কর্তব্য। তাছাড়া প্রত্যেকটা বিষয়ে অধিকারিত্ব বলে একটা বিষয় আছে। চোখে দেখা যায় না এমন বিষয়ে বাই-ডিফল্ট অধিকারী/অথরিটি হচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। চোখে দেখা যায় না এমনদের মধ্যে কেবল ঈশ্বরই হচ্ছেন বিজ্ঞানীদের আওতামুক্ত। এমনকি চোখে দেখা যায়, তেমন বিষয়ের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানীরাই চরম-অথরিটি। যেমন ধরুন, সরিষার তৈল বা তিসির তৈল। বিজ্ঞানীরাই বকে-বকে খেদিয়েছিলেন ওগুলো। আবার এখন ওগুলোর মধ্যে সরিষার তৈলকে বিজ্ঞানীরাই আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন। এরকম আরকি! সেজন্য আমাদের প্রশ্নাতীত সকল কিছু মেনে-মেনে, আরো আতঙ্কিত হতে-হতে জীবনপার করা উচিত, যতক্ষণ না করোনা বা অন্যকিছু মৃত্যুতে ঠাঁই দেয় আমাদের (এটা খানিকটা বুদ্ধদেব বসুর ‘ধৃতরাষ্ট্রের বিলাপ’ কবিতার মতো শোনাল, আমার কবিতাটার প্রতি পক্ষপাতের কারণে)।
তবে করোনা অদৃষ্ট (চোখে দেখা যায় না বিধায়) হলেও এর অধিকারী কেবল বিজ্ঞানীরা নন। এখানে করোনার সঙ্গে অন্যান্য জন্তুজানোয়ারের প্রকোপের পার্থক্য বিষয়ে আমাদের অবহিত হওয়া দরকার। যদি করোনার উপদ্রবের বদলে বনবিড়াল, বাদুড়, বানর এমনকি বাঘের উপদ্রবও দেশে দেশে হতো, তাহলে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে সামরিক বাহিনী, অবশ্যই নতুন বাজেটে, সেসব বনবিড়াল বা বাঘের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হতেন। আন্তঃরাষ্ট্রীক বানর-দমন বাহিনী গড়ে ওঠাও তখন আমাদের আকাঙ্ক্ষা হিসাবে দেখা দিত। বা আমাদের আকাঙ্ক্ষা না হলেও দেখা দিত। কিন্তু বাস্তবে সেই সুযোগ আমরা পাইনি।
কিন্তু তাই বলে এমনটা ভাবারও কারণ নেই যে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়েনি। এমন ভাবাও নেহায়েত অন্যায় যে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো কেবল দৃশ্যমান শত্রু নিধন করে। নানাবিধ অদৃশ্যমান জীবাণুর বিরুদ্ধে মানবতার লড়াইয়েই তাঁরা শুরু থেকেই তৎপর। তাছাড়া তাঁদেরকে নেহায়েত বিজ্ঞানীদের একটা আখড়া হিসাবে দেখাও আমাদের খুব অবিবেচকের মতো কাজ হবে। কোম্পানিগুলো যেমন হয় তেমনই বরং। নানাবিধ সিইও, ডিরেক্টর, ফিন্যান্স কনসালটেন্ট, মার্কেটিং ডিজাইনার, ক্যাম্পেইনার ইত্যাদিদেরই আখড়া মূলত। বিজ্ঞানীরাই বরং সেখানে আদরের আজ্ঞাবহ ছোটভাই(বোন) মাত্র।
তাই করোনার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীরা যা-যা বলছেন তা-তা অতীব সত্য কথা হিসাবে মানলেও আপনারা বিস্মৃত হবেন না যে তাঁদের বিগব্রাদাররা আপনাদের মুক্তিকল্পেই কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু মামলা যেহেতু কয়েক বিলিয়ন ডলারের, তাই পনেরো শ’ টাকা খরচ করেই অমর হয়ে যাবেন এই ভাবনা বৃহত্তর পরিস্থিতির দিকে আপনার অত্যন্ত লঘু, এমনকি স্বার্থপর ভাবনা। ফলে ধৈর্য বজায় রেখে অপেক্ষা করুন। নতুন বড় কোনো প্রাণঘাতী বিষয় ঘটলে এমনিতেই এই আতঙ্ক গৌণ হয়ে যাবে। তারপরও যদি মন না-মানে তাহলে গুগল সার্চ করে প্রতি বছর ইয়েতে কতজন মারা যায় সেই পরিসংখ্যানগুলো দেখে নেবেন। ইয়ের মধ্যে কলেরা থাকতে পারে, ইনফ্লুয়েঞ্জা থাকতে পারে, বাংলাদেশ যেহেতু আর্সেনিক থাকতে পারে। আর এইডস তো বৈশ্বিক! নাহয় সেটাই দেখলেন!
মানস চৌধুরী অধ্যাপক নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
0 Shares

Leave A Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

16 − four =