সায়েমা খাতুন
মোদীর আগমনের সুবাদে হঠাৎ করে আমাদের সম্পূর্ণ অজানা এক দেশী ভাইবোনের সন্ধান পেলাম, যাদের নাম মতুয়া। মতুয়া সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় আন্দোলন সম্পর্কে নীরব ইতিহাস হঠাৎ করে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে কথা বলে উঠলো ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের মঞ্চে। রাষ্ট্র আর রাজনীতি নিয়ে মনোযোগের আতিশয্যে এবং রাজনৈতিক মহা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ঘনঘটায় আমরা ভুলেই গেছি সমাজ বলে কিছু আছে, সম্প্রদায় বলে কিছু আছে, জ্ঞাতিসম্পর্ক, পরিবার বলেও আমাদের কিছু ছিল বা আছে। মতুয়া সম্প্রদায় কেবল একটি মুহূর্তেই তল থেকে সংবাদের পাতায় আবির্ভূত হল, যখন বাংলাদেশ এবং ভারতে রাজনীতির কোথাও তাঁদের একটা কর্তাসত্তা সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার রাজনীতির সাথে সমাজের ক্ষমতা ছেদ করেছে। এখন প্রশ্ন করতে হয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে আগত অতিথি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জন্যে কেন বাংলাদেশের গোলাপগঞ্জে মতুয়াদের প্রধান তীর্থস্থান ওড়াকান্দি সফর এতো গুরুত্বপূর্ণ?
মতুয়া গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার ওড়াকান্দির প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী এই ভুলে যাওয়া ভাইবোনদের সম্পর্কে খোঁজখবর করে জানতে পেলামঃ
গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে প্রায় ২১০ বছর আগে জন্ম হয় হরিচাঁদ ঠাকুরের, যিনি এই মতুয়া সম্প্রদায়ের সূচনা করেন। পরবর্তীতে তাঁর ছেলে গুরুচাঁদ ঠাকুরের মাধ্যমে বিস্তৃতি লাভ করে মতুয়া মতবাদ।ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের বাসস্থান ও এর আশেপাশের এলাকা মতুয়াদের কাছে পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। মতুয়াদের প্রধান মন্দিরও এখানেই অবস্থিত। “হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের ‘লীলাক্ষেত্র’ – অর্থাৎ তারা যেখানে থেকেছেন, ধর্ম প্রচার করেছেন, তাদের কর্মক্ষেত্র ছিল – মতুয়াদের কাছে তীর্থস্থান”, বলছিলেন কাশিয়ানী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সুব্রত ঠাকুর, যিনি হরিচাঁদ ঠাকুরের বংশধরও।পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের মোট ২৯৪টি বিধানসভার ১৪টি বিধানসভার আসনের ফল পুরোপুরি নির্ভর করে মতুয়া ভোটের ওপর। আর মোট ৬০ থেকে ৭০টি বিধানসভার আসনে ৫ থেকে ১০ হাজার করে মতুয়া ভোটার রয়েছে, যা এবারের বাস্তবতায় ফলাফলের নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে বলে বলা হচ্ছে (বিবিসি)।
মতুয়া ধর্মের ভিত্তি হল, আদর্শ গারহস্ত জীবন-যাপনে নিবেদন । মতুয়ারা ১২টি মূলনীতি পালন করে যাদের ১২ আজ্ঞা বলা হয়। মতুয়া ধর্মে নারী পুরুষের সমান অধিকার রয়েছে, বিধবা বিবাহকে উৎসাহিত করা হয়েছে এবং বাল্য বিবাহের বিরোধিতা করা হয়েছে। নারীপুরুষ যে কেউ এই ধর্ম প্রচার করতে পারে। এক কোটি মতুয়া এই ভাবধারায় জীবন যাপন করছেন। এমন একটা মানবতাবাদী জীবনবাদী ধর্ম, জীবন দর্শনের জন্ম এই বাংলাদেশের মাটিতেই হয়েছে জেনে অবাক এবং আনন্দিত হলাম।
১৮৬০ সালে হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রবর্তিত নিম্নবর্ণ হিন্দুদের এই ধর্মীয় আন্দোলন ব্রিটিশ-ভারতের অগণিত প্রতিরোধ আন্দোলনের একটি। রণজিৎ গুহ দেখিয়েছিলেন যে, ব্রিটিশ-ভারতে ১৮৫৭ সালের আগেও অন্তত ২০০ টি প্রতিরোধ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিলো, যা তাঁর বিবেচনায় ব্রিটিশ-ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র, আকার-আকৃতি-প্রকৃতি ঠিক করে দেয়। কেবল ব্রিটিশদের উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া ইউরোপীয় ধাঁচের রাষ্ট্রকাঠামোই আমরা পেয়েছি, তা নয়; পশ্চিমা জাতিরাষ্ট্রের মডেল সেটা আসলে এককভাবে একচেটিয়াভাবে করতে পারেনি। তল থেকে আসা অগণিত প্রতিরোধও ক্ষমতার কাঠামো- আকৃতি-প্রকৃতি স্থির করেছে। দক্ষিণ এশিয়ার নতুন এই রাষ্ট্রগুলো ঐতিহাসিকভাবে এই সব প্রতিরোধের মুখে ভিন্নরকম নিজস্ব চরিত্র নিয়েছে।
ইতিহাসের এবং আমাদের বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রের প্রতি অতি মাত্রায় ঝোঁক এবং পক্ষপাতিত্বের কারণে আমরা দেখতে পাই না যে, কিভাবে সমাজের ভেতর থেকে উঠে আসা নিরন্তর প্রতিরোধ-শক্তি ব্রিটিশ-ভারত এবং পরবর্তীকালের স্বাধীন ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, বার্মার মতো রাষ্ট্রকে বার বার নিজের মতো করে বদলে দেয়, নিজের আকারে গড়ে তোলে এবং ক্ষমতার খেলায় আপাতভাবে বেমক্কা নিজের বিরাশি শিক্কার দেশী এক চাল দিয়ে বসে। মতুয়া সম্প্রদায় দেশজ সমাজের পাটাতনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মাটির গভীর শেকড় থেকে আজকের ইতিহাসের খেলায় তাঁর নিজস্ব নিয়মে নিজস্ব স্বর শুনিয়ে দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের ভোট ব্যাংকে তাঁদের এই প্রভাব এবং পশ্চিমবঙ্গের বামজোটের সেই ভোট ব্যাংকে ঢোকার জন্যে মোদীর বাংলাদেশে অবস্থিত তীর্থক্ষেত্র দর্শন, এবং ঠাকুরবাড়ী দর্শন আমাদের সামনে কয়েকটি শিক্ষা হাজির করেঃ
১। সমাজের ভেতর যে আন্দোলনগুলো জৈবভাবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হয়ে বিরাজ করে, সেগুলো নিজের পদ্ধতিতে রাজনীতিতে কর্তা হয়ে কাজ করে, সক্রিয় থাকে। কিন্তু আমাদের বুদ্ধিজীবীতার কিম্বা গণমাধ্যমের রাষ্ট্রবাদী লেন্সে সেটা ধরা পড়ে না।
২। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের আগের ব্রিটিশ-বিরোধী সংগ্রামগুলো আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য ইতিহাসই শুধু নয়। সেটা আমাদের অবিচ্ছেদ্য বর্তমান।
৩। মতুয়াদের মতো দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য সম্প্রদায় এবং সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনকে এখনকার মাঠে ময়দানের গনতন্ত্রকামী এবং বৈষম্য-বিরোধী সংগঠনগুলোর চিনে নেয়া প্রয়োজন।
৪। এমন অসংখ্য সমাজ এবং সম্প্রদায়, জ্ঞাতিগোষ্ঠী জাতিরাষ্ট্রের তলায় পাটাতন হয়ে আছে, যারা ভীষণভাবে জীবন্ত এবং সক্রিয়, যাকে আধুনিক গণতন্ত্রের নাগরিক সমাজের সেকুলার মিটিং, মিছিলকেন্দ্রিক কর্মসূচি ও রাজপথের সংগ্রাম রচয়িতারা বুঝতে পারেন না। কট্টর সেকুলারদের কাতারে অনেক সময় গনমানুষ তাঁর বিশ্বাস, মূল্যবোধ, চর্চা, জীবনধারা নিয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথ খুঁজে পায় না।
৫। ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান-বার্মা, ব্রিটিশ-ভারতের রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর সৃষ্টি হয়েছে বলে এই অঞ্চলের একটা সাধারণ অতীতের মতো একটা সাধারণ বর্তমানও আছে। সেটা ভবিষ্যতের স্বার্থেই আমাদের স্বীকার করে নিতে হয়। নয়তো ভারতীয় কর্পোরেট হিন্দুত্ববাদী আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বোঝাবুঝি ত্রুটিপূর্ণ থাকবে।
৬। মতুয়াদের মতো সম্প্রদায়গুলো যারা দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোর বহুত্ববাদী পরমতসহিষ্ণু ন্যায়বিচারের বুনন জৈবভাবে এই মাটিতে বুনে রেখেছেন, সেই বুননকে ছিন্ন করবার প্রচেষ্টা প্রতিহত করবার উপাদান এই সমাজের ভেতরেই আছে। রাষ্ট্রবাদী চিন্তুকদের সেটা মাথায় নিতে হবে। তাহলে একটা সার্বক্ষণিক সেকুলার হতাশার চাষবাস অনেকাংশে বন্ধ করার সুযোগ আসবে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ জামান মণি
তথ্যসূত্রঃ
https://www.bbc.com/bengali/news-56497194
https://www.news18.com/…/explaining-pm-modis-matua…
https://sanatanpandit.com/what-is-matua
সায়েমা খাতুন সহযোগী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।