মঈন জালাল চৌধুরী
বিগত এক মাস ধরে নেটফ্লিক্সে “ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু ইন কালার” দেখছি। একবিংশ শতকের মানুষ হিসেবে এটা দেখা আবশ্যক বলে মনে করি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর সংকটকালীন জার্মানীকে উজ্জ্বিবিত করতে এবং পুনর্গঠন করতে যেয়েই ছোট ও বড় হিটলারদের কী কী সাধ জেগেছিল তা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। হ্যা, ঠিকই ধরেছেন আমি একজন হিটলারের কথা কেবল বলছি না। আমি দেখছিলাম যে একজন হিটলার কত রকমের হিটলার তৈরি করেছিলেন। অথোরিটেরিয়ান প্রবণতা এমনই সংক্রামক। যেমন হিটলারের চারপাশেই আমরা দেখতে পাই প্রোপাগান্ডা এক্সপার্ট, নৃশংসতা এক্সপার্ট, স্যাডিস্ট, রণকৌশলি, বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, মানে অনুগামীদের বিরাট একটা দল। সেসব দলের নেতা পাতি নেতারা। তারা আবার নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতারত; কে কত বেশি আনুগত্য-প্রবণ হবেন সেটা নিয়ে। অথোরিটেরিয়ান রেজিমে আনুগত্য আবশ্যক গুণাবলী এবং চর্চাও। মানে আপনি অনেকক্ষেত্রে আনুগত্যপ্রবণ না হলেও, মনে মনে বিরোধীতা করলেও সেটা প্রকাশের জায়গা আসলে নেই। আসলে নিজের ভেতরেও নেই। মানে সেটাকে বলা যেতে পারে অন্তরের সেন্সরশীপ। এই বিষয়টা আরো ডিটেইলে দেখতে চাইলে দেখতে পারেন আমাজন প্রাইমের আরেকটি সিরিজ, “দ্যা ম্যান ইন দ্যা হাই ক্যাসেল”।
তো যা বলছিলাম, অথোরিটেরিয়ান আনুগত্যের আরেক ধরনের ফলাফল হিসেবে খুব ছোট আকারে বিকশিত হয়েছিল রেজিমের প্রতি “বিশ্বাসঘাতকতা”-র একটা জায়গা। এমনটাই কি হওয়ার কথা নয়? বিশেষ করে যখন বিরোধীতা বন্ধ বা বিরোধীতা যখন প্রেসক্রাইবড? তখন তো যা অথোরিটেরিয়ানের জন্য সমস্যাজনক বলে অথরিটি মনে করেন, তাই “বিশ্বাসঘাতকতা”। কারণ বিরোধীতা আর আনুগত্য দুটোই ডিফাইন করে দিচ্ছে অথরিটি। আপনার কোন সে নাই। ফলে হিটলারের হত্যাচেষ্টার কিছু ঘটনাও আমরা দেখি। তবে তারচেয়ে দশ-বিশগুণ অধিক হারে দেখি গোপন বা প্রকাশ্য পোলিসিং দলের উত্থান। যারা বিপুল উৎসাহে “অথোরিটেরিকে” প্রশ্ন করতে পারে, এমন চিন্তা বা কল্পনাকারীদের; সর্বোচ্চ নৃশংসতার সাথে দমন করার জন্য হেন কোন কাজ যা করেনি। এই দলগুলো সবসময় হাই কমান্ডের নির্দেশেই হয়েছে তা নয়, বিপুল অতি-উৎসাহি স্থানীয় উদ্যোক্তারাও করেছেন।
আরেকটা জিনিসও দেখলাম আর তা হল হিটলারের কী বিপুল জনপ্রিয়তা! প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়, অর্থনৈতিক অবরোধ আর জামার্নীর ভেতরে গভীর সংকটের কাল। আর তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত হিটলারের পুনঃর্গঠন প্রচেষ্টা আর জার্মান জনগণের মাঝে হিটলারের ক্রমশ জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি। হিটলার তো কান্ডারীর ভূমিকাই পালন করছিলেন। দৃশ্যপটের ধারাবাহিকতা এমনঃ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যন্ত্রণা থেকে আস্তে আস্তে জার্মানী উঠে দাঁড়ালো, শক্তি সঞ্চয় করল, মাতবর হল, দখলদার হতে শুরু করল আর মহান সব সভ্যতা রেইস, পুর্নজীবিত করার ডিলিউশনে ভোগা শুরু করল। নিজে তো ভুগলই বাকী কোটি কোটি মানুষকেও ভোগাল।
সে সময়ের ধারা বর্ণনাকারী এক বিশ্লেষক তো বলেই ফেললেন, বিষয়টা ছিল, মেইক জার্মানী গ্রেট এগেইন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানো, নিজেরা শক্তিশালী হওয়া এবং এরপর এই গ্রেট বানানো। একদম টেক্সটবুক নায়কোচিত ন্যাশনালিজমের গল্প। আসলে অথোরিটেরিয়ান ন্যাশনালিজমের গল্প এইটা। আপনারা প্রশ্ন করতেই পারেন তাহলে এত মানুষকে অথবা অন্যভাবে বললে “জনসাধারণকে” একত্রিত করার আর কী উপায় আছে? সেটা নিয়ে আপনারা একটু ভাবুন তাহলে।
তবে আমি লক্ষ করলাম যে অথোরিটেরিয়ান রেজিমের একটা কোর বৈশিষ্ট্য হল, কেন্দ্রীয় ব্যক্তির নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ, এবং বিশ্বাস ভয়াবহ সংক্রামক। যেমন হিটলার মনে করতেন যে ইহুদীরাই যত নষ্টের গোড়া। আবার তিনি এও জনতেন যে প্রথমেই ইহুদীদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন ভূমিকা নিলে তা তখনি জনপ্রিয় হবে না। ফলে তিনি আস্তে আস্তে ইহুদীদের বাদ দেয়া, সরিয়ে দেয়া, কোনঠাসা করার কাজটি শুরু করলেন। আস্তে আস্তে দুই আড়াই বছরের মাথায় জার্মান জনসাধারণ সেটি মেনেও নিলেন; অন্তত প্রতিবাদ করলেন না। একদল চাকরী থেকে বিতাড়িত হলে উনাদের লাভই হচ্ছিল। একজন ইহুদীর চাকরী গেলে বিশুদ্ধ “এরিয়ান রেইসের” জার্মানরা চাকরী পেয়েছে। তারা নিজেদের আবেগ অনুভূতিকে চাপা দিয়ে গেছে। উপেক্ষা করে গেছে। উনারাও চুপচাপ ভালো আছি-র আরামে জীবন যাপণ করতে থাকলেন। আরো কিছুদিনের মধ্যে সেটাই নর্ম বা সর্বজন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল। পপুলিস্ট চর্চায় এবং পরে বিশ্বাসে পরিণত হল।
পপুলিজমের সাথে একক সিদ্ধান্তের কী যে এক দারুণ সংযোগ। গোয়েবলসও সমানতালে তাল মিলিয়ে যাচ্ছে এবং প্রোপাগান্ডা প্রতিভা বিকশিত করছে। একদিকে যেমন জ্বী হুজুরের বাইরের কোনকিছুই হিটলারদের কান শোনেনা তেমনি যারা একই চেতনায় বিশ্বাসী তারাও তো জানপ্রাণ দিয়েই কাজটি করবেন। সেটাই দেখা গেল। পুরো গণমাধ্যমের সাথেই এই বিষয়টার কি দারুণ সংযোগ। সেই সময়টাতে রেডিও খুব আরাধ্য এবং ইমিডিয়েট একটা মিডিয়া। বাজারে বেশ দাম; তবে দেখা গেল যে সরকারী প্রণোদনায় খুব সস্তায় রেডিও দেয়া হচ্ছে। সে সময়ে সেটাই নিউ মিডিয়া। তখনি আমার মনে হল, আরে আমাজন যে এত সস্তায় কিন্ডেল দেয়, হার্ডওয়ার দেয়, গুগল সার্ভিস দেয়, ফেইসবুক সোশ্যাল মিডিয়া দেয়, সেই বিষয়টার কাহিনী কি? যাই হোক সেটা আপনারা ভাববেন।
ফিরে আসি আগের কথায়। তখনকার সেই নিউ মিডিয়া মানে রেডিও কাজ করেছে জোসেফ গোয়েবলসের পরিকল্পনা অনুযায়ী। রেডিওতে সময় নিয়ে আস্তে আস্তে ইহুদী বিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরি করা হয়েছে। একশ বছর পর সোশ্যাল মিডিয়াওতো আবার নিউ মিডিয়া। সেটা নিয়ে বিরাট হইচই; তবে খেয়াল করে দেখুন সোশ্যাল মিডিয়াতেও এসময় নানান পদের গোয়েবলসদের দেখা যায়। যার সহমত, একমত গ্রুপের পরিচালক এবং সদস্য। তারা “নিজ” ও “অপর” বানিয়ে ক্রমাগত নিজেদের কার্য সম্পাদন করছেন।
বিপুল যে জনপ্রিয়তা হিটলার আস্তে আস্তে অর্জন করেছে তার কৌশল ছিল “অপরকে” তৈরির করার মাধ্যমে। মেইক জার্মানী গ্রেট এগেইন ই ছিল এই কৌশলের খোলসটি, যেখানে ছদ্ম বিজ্ঞান দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে যে জার্মানরা উন্নত জাতি, আর্য। যাদের থাকবে নীল-সবুজ চোখ, দেহের গড়ন হবে নর্ডিকদের মত আর বাকীরা? তারা অধস্তন এবং ইংরেজিতে যে শব্দটা বেশ যুৎসই এক্সপেন্ডেবল। এখনও তো বিজ্ঞান-বিশ্বাস-এক্সপার্টদের দিয়েও কি এরকম করানো হয় না? এমন কাজ কিন্তু আমরা হরহামেশাই দেখি। বিভিন্ন মাধ্যমে সারাক্ষণ “অপর” তৈরির খেলা চলে। এক “অপর” আরেক “অপরের” উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জিনিসটা নতুন নয়। জার্মান এম্পায়ার তৈরির খায়েশে পুরো ইউরোপ দখল করে পরিসর আর বড় করার দিকেই ধাবিত হচ্ছিল হিটলার, মানে “আমরা নিজেরা বড় হবো” বাকীরা বাদ তারা এক্সপেন্ডেবল। তবে এও লক্ষনীয় যে যুদ্ধের শেষ দিকে হিটলার কীভাবে একের পর এক তার জেনারেলদের খালি বাদ দিচ্ছে। এখন হয়ত বলতে পারি। হিটলার এক গোঁয়ার, ডিলিউশনাল এক নৃশংস শয়তান আহাম্মক। আপাতত যতই পারঙ্গম মনে হোক না কেন আসলে ভয়ংকর ক্ষতিকারক। কারো কথাই শুনছে না। একের পর এক স্ট্র্যাটেজি ফেইল করছে, সে মানছেই না। একইভাবে সে চালিয়ে যাচ্ছে। যার বলি হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। কোনকিছুই সে মানছে না। কিন্তু হিটলার যখন খুব শক্তিশালী তখন বা তার আগের বছরগুলোতে একথাগুলো কেইবা বলতে পেরেছিল? কেন বলতে পারেনি?
যদিও যুদ্ধের প্রথম কয়েক বছরের হানিমুনের পরের কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথমে জার্মান সেনা এবং জনগণ মরতে থাকল। এক নিষ্ঠুরতার সাপেক্ষে আরো বড় নিষ্ঠুরতা হাজির হতে থাকল। যেমন মিত্রশক্তি বলল: “তোমরা লন্ডনে বোমা মেরেছো আমরা ড্রেসডেন পুড়িয়ে দিয়েছি।”। যদিও জার্মানরা একের পর এক এরপর মাটিতে মিশে গেল। জাপানের গল্পও তাই। জার্মানীর এশিয়ান কপি করতে থাকল এরপর বোমা খেয়ে চুপ হল। কিন্তু দুই পক্ষের যুদ্ধে কতজন জনসাধারণ হত্যা হলেন তা কি জনসাধারণ কখনো প্রশ্ন করেছেন?
জার্মানী ও জাপান দুই দেশেই বিপুল জনপ্রিয়তা আর আনুগত্যের মাখামাখি। তবে কিন্তু পরিণাম ভয়াবহ। গেল দেড় দশকে আবারো সেই একক কতৃত্ব আর বিপুল জনপ্রিয়তার উত্থান সারা বিশ্বে। কারণটা আর কিছুই নয়, গণতন্ত্রের প্রমিস রক্ষা করতে না পারা। গণতন্ত্রের নানা দোষ। কোন সন্দেহ নেই। তবে ভিন্নমতের জায়গা থাকলে কারেক্ট করার সুযোগ বেশি। যে কোন ক্রাইসিসে অথোরিটেরিয়ান পপুলিজম এর একক সিদ্ধান্তের বিকার বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। বিশেষ করে দুর্নীতিগ্রস্ত কোন রাষ্ট্রে জনসাধারণের এই দাবী তোলা স্বাভাবিক। আর যদি অতিমারি হয় তখন মানুষ আর্জেন্সিতে খালি ইমিডিয়েট বিপদ থেকে বাঁচতে চায়। ফলে দেখবেন প্রায়ই এরকম পরিস্থিতি হলে মানুষ বলে, “এখন দরকার মিলিটারী”। যতদূর বুঝি আসলে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দ্রুত কঠিন পরিস্থিতির সমাধান চান তাঁরা। এটা খুব সত্য যে ক্রাইসিস জিনিসটাকে তেনা পেচিয়ে লম্বা করার কোন মানে নেই। তেমনি এক ধাক্কায় যে সবকিছুর সমাধান হয় না সেটার বোঝাবুঝি আগে থেকেই পরিস্কার থাকা দরকার। মানে জোড়াতালি দিয়ে বন্যা ঠেকানো আসলে যায়না।
বিপুল মানুষের সমাগমের রাজনীতি আমাদের এ অঞ্চলে প্রবল। বিপুল জনসমাবেশ আয়োজন, লক্ষ জনতা রাজপথে হাজির করা ইত্যাদি বিরাট রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে পরিগণিত। তাই করোনা অতিমারির সময়েও বিপুল জনসমাবেশের রাজনীতি বন্ধ হয়নি। সুযোগ পেয়েই মাথাচাড়া দিয়েছে। আর নতুন টেকনোলজির কারণে বিপুল জনসমর্থনের যে অনলাইন রাজনীতি তৈরি হয়েছে সেটিও ভীষণ প্রভাবশালী। আমাদের মধ্যেই প্রবল পপুলিজম আছে। কিন্তু করোনা মোকাবেলায় এসব যথেষ্ট নয়। ইতিহাস পরিস্কার করে বলছে যে এসব যথেষ্ট নয়। জনসমাবেশ আর অথোরিটির আনুগত্যের এলিট গোষ্ঠী দিয়ে করোনা মোকাবেলা করা যাবেনা। এইসব ক্ষেত্রে দূরদর্শী বিবেচনাবোধ সম্পন্ন মানুষ সমূহের একসাথে কাজ করতেই হবে। আর কোন উপায় নেই। একবার করলে হবে না, ধারাবাহিকভাবে করতে হবে। কারণ করোনাতো থামছে না। করোনার মূল আক্রমণের জায়গা, “অথরিটারিয়ান পপুলিজম”। এটা বন্ধ করেন দেখবেন করোনা মোকাবেলা ঠিকমত করা যাচ্ছে। না হলে দেখবেন প্রচুর মূর্তি আর ভাবমূর্তি হবে এসব নিয়া কথা হবে কিন্তু অক্সিজেন প্ল্যান্ট হবে না।
মঈন জালাল চৌধুরী সহকারী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অফ লিবারেট আর্টস। পি এই চ ডি ও পোস্ট ডক করেছেন জাপানের হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর গবেষণার আগ্রহের বিষয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও রাজনীতি। প্রযুক্তি ও সমাজের গতিশীল সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করছেন এবং সেটির ফলাফল হিসেবে কীভাবে অনলাইন ভিত্তিক ধর্মীয় পাবলিক স্ফিয়ার তৈরি হচ্ছে, দূর্নীতির সাথে মোকাবেলায় কীভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কাজ করছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গভার্নমেন্টালিটি এসব বিষয়ে তাঁর লেখালেখি তৈরি হচ্ছে।