ভাষান্তর: খলীলুল্লাহ মুহাম্মাদ বায়েজীদ
কিছুদিন আগে আমি লন্ডনে অবস্থিত হাইগেট কবরস্থানে কার্ল মার্ক্সের সমাধির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাবছিলাম, ১৮১৫ সালের ৫ মে মোতাবেক জন্মের ২০০ বছর পরে আজ আমাদের জন্য তার [কার্ল মার্ক্সের] নতুন করে কিছু বলার আছে কি না। তার সমাধি প্রস্তরের উপরে বড় অক্ষরে খোদাই করে লেখা রয়েছে “দুনিয়ার মজদুর এক হও।” কিন্তু বাস্তবে শোষিতদের সংহতি নেই বললেই চলে; অথচ এটিকে মার্ক্স পুঁজিবাদকে শেষ করার প্রয়োজনীয় হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
১৭০ বছর পূর্বে তিনি এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস তাদের বিখ্যাত বই The Communist Manifesto (দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো)তে লিখেছিলেন, “বুর্জোয়া শ্রেণী সর্বোপরি তারই গোর-খোদকদের সৃষ্টি করে। এর পতন ও সর্বহারা শ্রেণীর বিজয়ও সমানভাবে অনিবার্য।” বাস্তবতা আসলে তা নয়: পুঁজিবাদ আজ প্রকাণ্ড ও তেজস্বী রূপ ধারণ করেছে। পুঁজিবাদ নিজকে বাঁচিয়ে রাখতে তার গোর-খোদকদেরও নিজেদের দলভূক্ত করেছে- দার্শনিক হেগেল এই ঐতিহাসিক বিড়ম্বনাটিকে যুক্তির ধূর্ততা বলে অভিহিত করেছিলেন। উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। কেবলমাত্র বাহ্যিক বিবেচনায় আমরা চীনকে বর্তমান বিশ্বের বৃহত্তম সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে জানি। অথচ দেশটি পুঁজিবাদী উদ্যোগগুলোয় সস্তা শ্রম সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা শ্রমিকদেরকে বঞ্চিত করে যাচ্ছে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, মার্ক্স কি বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক? এর উত্তর হলো একদমই না। আমি মনে করি, অনুপযুক্তভাবে আশাবাদী ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য নয়; বরং কোন সমস্যাকে চিহ্নিত করার জন্য মার্ক্সকে অধ্যয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, তিনি এবং এঙ্গেলস বিশ্বায়ন কীভাবে কাজ করবে তা আগে থেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তারা লিখেছেন, “দেশে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার করে আগে যে চাহিদা মেটানো যেত, সে জায়গায় বর্তমানে নতুন নতুন চাহিদা যুক্ত হচ্ছে , যেগুলো মেটাতে দূরবর্তী রাষ্ট্র ও নির্দিষ্ট অঞ্চলের পণ্য প্রয়োজন।” এ কারণেই চায়নিজ কর্মীরা এমন সব পণ্য তৈরি করছেন, সে সম্পর্কে আমাদের লোভ করাতো দূরে থাক, তা আমরা কখনও কল্পনা করি নি। আর এই সব পণ্যগুলো আমাদেরকে রাজনীতি বিমুখ, চরমমাত্রার অসামাজিক মনোভাবী ও স্বপ্নচারী স্বকামী ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করবে। নিশ্চয়ই পাঠকবৃন্দ আপনারা বুঝতে পারছেন যে, এখানে আমি আইফোনের কথাই বলছি।
মার্ক্স এবং এঙ্গেলস বর্ণিত যে বিশ্বে আমরা বর্তমানে বসবাস করি তা মাথায় না এনে কম্যুনিস্ট ইশতেহারের প্রথম কয়েকটি পৃষ্ঠা বোঝা বেশ কঠিন। তারা লিখেছেন, “উৎপাদনের ক্রমাগত বিপ্লব ঘটানো, সকল সামাজিক অবস্থার নিরবচ্ছিন্ন বিড়ম্বনা, চিরস্থায়ী অনিশ্চয়তা এবং আন্দোলন বুর্জোয়া [পড়ুন বর্তমান] যুগকে আগের সমস্ত সময়ের থেকে আলাদা করে তোলে।” আমরা ঠিক তেমনই একটি পৃথিবীতে বাস করি। তবে আমাদের পৃথিবী তাদের [মার্ক্স এবং এঙ্গেলস এর] কল্পনার [পৃথিবীর] চেয়েও শক্তিশালী ও প্রকাণ্ড। আমার মতে, এই কথাগুলো অতি দ্রুত বিপুল অর্থের মালিক বনে যেতে উবার, ডেলিভারু এবং গিগ অর্থনীতির মূল্যবোধ ও মানদন্ডের বাছবিচারহীন অন্যান্য উদ্যোগগুলোকেই শুধুমাত্র তুলে ধরে না, বরং এর পাশাপাশি ট্যাক্স এড়ানো শেয়ারহোল্ডারদের সন্তুষ্ট করতে যেয়ে এই গ্রহ বা পৃথিবী কীভাবে লুন্ঠিত/বঞ্চিত, সে চিত্রও তুলে ধরে।
দ্যা কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো এবং দ্যা কাপিটালে প্রশিক্ষক পূজা থেকে শুরু করে ফেসবুক উত্তেজনা পর্যন্ত সকল বিষয়েরই আলোচনা রয়েছে।
মার্ক্সবাদী অধ্যাপক ডেভিড হার্বির প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করা যায়, যিনি সম্প্রতি ব্রাজিলের সাও পাউলো শহরের উপর গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, এই সাও পাওলো শহরের অর্থনৈতিক ভিত্তি হলো একটি গাড়ি নির্মাণ শিল্প। তবে, এখান [এই গাড়ি নির্মাণ শিল্প] থেকে যে যানবাহনগুলো তৈরি হয়- সেগুলো এ শহরের ট্রাফিক জ্যামে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে আটকে থাকে, রাস্তাগুলিকে দূষিত করে এবং [জনগণকে] একে অপর থেকে পৃথক করে রাখে। মুক্ত-বাজার অর্থনীতি কীভাবে সত্যিকারের মানুষের বাস্তব প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর ও অনিরাপদ- এটি তার একটি শক্তিশালী উদাহরণ।
কার্ল মার্ক্স তার লেখালেখিতে ফেসবুকের পূর্বাভাস দিতে পারেননি- এটি সত্য। কিন্তু মার্ক জাকারবার্গের ব্যবসায়ের মডেলটির প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। বলা যায় এক্ষেত্রে তার বোঝাবুঝি গত মাসে মার্কিন কংগ্রেসনাল শুনানিতে আমেরিকান সিনেটরদের চেয়েও ভাল।[2] মার্ক্স এবং এঙ্গেলস অত্যন্ত চমৎকারভাবে লিখেছিলেন, “নগ্ন ব্যক্তিস্বার্থ ও নির্বিকার ‘নগদ লেনদেন’ ছাড়া বুর্জোয়া শ্রেণী মানুষের সঙ্গে মানুষের আর কোনো বন্ধন বাকি রাখেনি। এরা ধর্মীয় উদ্দীপনার স্বর্গীয় ভাবোচ্ছ্বাস, শৌর্যমণ্ডিত উৎসাহ ও কুপমণ্ডক সংবেদনশীলতাকে আত্মসর্বস্ব হিসাব নিকাশের বরফ-জলে ডুবিয়ে মেরেছে।”
অ্যামাজন এবং গুগলসহ ফেসবুক মানুষকে শোষণযোগ্য সম্পদে পরিণত করেছে, যা একরকম প্রতিভাও বটে।
কিন্তু মার্ক্স ১৮৬৭ সালে তার বিখ্যাত Das Kapital (পুঁজি) গ্রন্থে পণ্য পূজা (কমোডিটি ফ্যাটিশিজম) সম্পর্কে লিখেছিলেন। আমি মনে করি, আজ আমাদের জন্য এটিই সবচেয়ে বেদনাদায়কভাবে সম্পৃক্ত। এই প্রত্যয়টির দ্বারা তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, কীভাবে শ্রমিকদের উৎপাদিত সাধারণ জিনিসগুলো, যেমন- আইপ্যাড, গাড়ি ও এমনকি কার্ল মার্ক্স-এর ২০০ তম জন্মদিনের স্মরণে রচিত নতুন বই- পুঁজিবাদের অধীনে এসে অসাধারণ হয়ে ওঠে। কিছু ধর্মে কোন সাধারণ বস্তুর উপর অতিপ্রাকৃত শক্তি আরোপের ফলে খোদ সেই বস্তুটিই যেমনি উপাসনাকারীদের কাছে পূজনীয় হয়ে ওঠে, তেমনি পুঁজিবাদের অধীনে পণ্যগুলো যাদুকরী শক্তিতে অসাধারণ হয়ে ওঠে।
যখন একটি আইফোন বিক্রি হয় তখন এটি অন্য একটি পণ্যের সাথে বিনিময় ঘটে। সাধারণত টাকা বা অর্থের সাথে এই বিনিময় হয়। এই বিনিময়ের ক্ষেত্রে আইফোন তৈরিতে শ্রমিকদের শ্রম বিবেচনায় আসেনা। এমনকি আপনার আমার জন্য গেজেট তৈরি কেন্দ্রিক জীবন থেকে বাঁচার জন্য অ্যাপলের নিম্ন মজুরের শ্রমিকদের আত্মহত্যার প্রবণতাও ছোট করে দেখা হয়। মার্ক্স লিখেছেন, “একটি পণ্য তাই একটি রহস্যজনক জিনিস কারণ কারণ পণ্যের মাধ্যমে পুরুষের শ্রমের সামাজিক চেহারা, তাদের কাছে উৎপাদিত পণ্যে খোদাই করা, বস্তুগত চরিত্র হিসেবে প্রতীয়মান হয়।
ফ্র্যাঙ্কফুর্ট স্কুলের চিন্তাবিদদের উপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করা অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও তাত্ত্বিক গাইরিগি লুকাকস। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে, পণ্য পূজা প্রবলভাবে প্রচলিত রয়েছে এমন পৃথিবীতে নতুন ধরণের মানবের উত্থান ঘটছে। সেই নতুন মানুষজন এতটাই অধ:পতিত যে, কেনা-বেচাই তাদের আসল বিষয়: আমি যা কিনি/কেনাকাটা করি, তাই আমি।[3] পুঁজিবাদের অবসান ঘটাতে ঐক্যবদ্ধ না হয়ে আমরা আরও জুতো কিনতে থাকি। [আরেকটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে] যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত খেলাধূলা-ফ্যাশন সামগ্রী বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান জেডি স্পোর্টস (JD Sports) গত মাসে [২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের কথা] মুনাফায় ২৪ বৃদ্ধি ঘোষণা করে। এ বিষয়টিকে আমি ব্রিটিশ ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির সাথে মিলিয়ে বিশ্লেষণে আগ্রহী নই। বরং এটিকে আমি [গাইরিগি] লুকাকস এর অধ:পতিত ব্যবস্থা সম্পর্কিত মতামতকে সমর্থন করে পাদুকা পূজা হিসেবে বিশ্লেষণ করতে চাই। যেমনটি অন্য এক প্রসঙ্গে ম্যালকম এক্স বলেছিলেন, আমাদেরকে নিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমরা হয়েছি।
এমন একটি বিশ্বে যে কোন কিছুর পতন খুবই সহজ। যেমন সমাজ পরিবর্তনের যে বিপ্লবী চিন্তায় কার্ল মার্ক্স বিভোর ছিলেন, সে চিন্তাধারা থেকে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট স্কুলের বেশিরভাগ চিন্তুক দূরে সরে দার্শনিক কোয়েটিসম [Philosophical Quietism] এর দিকে ঝুঁকে পড়েন। “দার্শনিকেরা কেবল বিশ্বকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যাই করে গেছেন, কিন্তু আসল কাজ হল তা পরিবর্তন করা”- তাঁর [কার্ল মার্ক্স এর] সমাধিস্থলটিতে খোদ নিজের এই কথাও স্পষ্ট করে খোদাই করা আছে।
এটি এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। আমরা যে জটিল বিশ্বে বসবাস করছি- তা বুঝতে আমাদের কার্ল মার্ক্সকে প্রয়োজন। কিস্তু তাঁর লেখালেখি ও চিন্তাধারা এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য পর্যাপ্ত নয়। তবে নি:সন্দেহে এটি [কার্ল মার্ক্স-এর চিন্তাধারা] এই বৃহত্তর লড়াইয়ের সূচনা এনে দিতে পারে মাত্র/ সূচনা বিন্দু/উপস্থাপনা মাত্র।
খলীলুল্লাহ মুহাম্মাদ বায়েজীদ: শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি’র সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। আগ্রহের জায়গা- জনসংস্কৃতি, স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ধর্ম ও সেক্যুলারিজম। ইমেইল: [email protected]