সুস্মিতা চক্রবর্তী
বইটির নাম: আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত এবং একটি নারীবাদী ঘোষণাপত্র।
লেখক: চিমামান্দা এনগোজি আদিচি।
অনুবাদক: শিমিন মুশশারাত।
প্রকাশক: বাতিঘর। প্রচ্ছদকার: তৃত তথাগত।
অনেক দিন পর দিনে দিনেই একটা বই অনায়াসে পড়ে শেষ করতে পারলাম। দুটি রচনা নিয়ে লেখা বইটি। পড়তে গিয়ে মনে হলো নিজের মনোভঙ্গি দেখছি ওতে। কেমন যেন মিলে যাচ্ছে সব যা কিছু এই চল্লিশোর্ধ্ব জীবনে অভিজ্ঞতা করেছি নানা স্তরে। ব্যক্তিগত পরিসরে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিসরে নিজের অভিজ্ঞতা, আপোষ, লড়াই সমস্তই যেন মিলে যায় লেখকের লেখার সাথে। নিজের প্রত্যাশিত যে সমাজের কথা একান্তে লালন করার লোভ এখনও ছাড়তে পারি নি সে কথারই অনুরণন, প্রতিফলন টের পাই বইটির পরতে পরতে। সংহতি তৈরি হয়। এ সংহতি ‘আমি’র সাথে ‘আমাদের’! কী দারুণ সে ভগিনীত্ববোধ কিংবা বন্ধুতারও। অত্যন্ত সহজ-সাবলীল কথায় নিজের লিঙ্গীয় পরিচয়ের হেতুজনিত নানা সমাজ-বৈষম্যের সূক্ষ অথচ দরকারি পর্যবেক্ষণগুলো যে-কোনো সংবেদনশীল মানুষকেই ভাবাবে। বিশেষত নারীরা একাত্মতা বোধ করবে সন্দেহ নেই। বইটির দ্বিতীয় রচনা ‘একটি নারীবাদী ঘোষণাপত্র’ অংশটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, আগামীর নারীরা কিভাবে বেড়ে ওঠবে কিংবা কিভাবে একজন কন্যাশিশুকে বড় করে তোলা ভবিষ্যতের কাঙ্ক্ষিত ও অধিক ন্যায্য সমাজের জন্য অতিশয় দরকারি সে বিষয়ে চমৎকার পরামর্শ মিলবে রচনাটিতে৷ ফলে পরামর্শমূলক রচনাটি মা-বাবাদের জন্য অধিকতর মূল্যবান।
আমাদের সমাজে কিছু মানুষ আছেন যারা নারীবাদ নিয়ে নিজের অজ্ঞতায় ভোগেন, ভোগান চারপাশকে। তারা ভোগেন বিশেষ করে আদিচির পরিভাষায় ‘লঘু নারীবাদীদের’ আচরনেও। তারা নারীবাদের স্থলে মানবাধিকার বলতে বেশি স্বস্তি পেয়ে থাকেন৷ তাদের অজ্ঞতা দূর করতে আদিচির কথায় বলা যেতে পারে, নারীবাদ অবশ্যই মানবাধিকারের একটা অংশ। কিন্তু মানবাধিকারের মতো অস্পষ্ট একটা শব্দ এক্ষেত্রে ব্যবহার করলে লিঙ্গের যে নির্দ্দিষ্ট ও স্বতন্ত্র অসংগতি রয়েছে সেটাকে অস্বীকার করা হয়৷ কারণ সমস্যাটা মানুষ হওয়া নিয়ে নয় বরং সমস্যাটা একেবারেই নারী হওয়া নিয়ে। এমনকি এখনও যারা নারীবাদকে কোনো সংজ্ঞা দিয়ে বুঝতে ব্যর্থ হয়ে আর ‘সমাজ ছাঁচে’ বেড়ে ওঠায় নারীবিদ্বেষে বা পুরুষবিদ্বেষে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাদের জন্য একটা সাধারণ বোধগম্য যৌক্তিক সংজ্ঞাও বইটিতে খুঁজে পাওয়া যায়: ‘যে ব্যক্তি সব লিঙ্গের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমতায় বিশ্বাসী’। ফলে, নারীপুরুষ সকল মানুষই নারীবাদের এ ধারণা পোষণ ও চর্চা করে কার্যত নারীবাদী হতে পারেন৷ বিদ্যমান পৃথিবীতে নারীবাদী হওয়া নারীপুরুষ সকলের জন্যই যে কাজের এটাও এটি পড়ে অনুধাবন করা যায়।
নারীর জন্য তো বটেই পুরুষের জন্যও আদিচির লেখা এই বইটি নানা ভাবনা দেয়। জটিল কোনো ভাবনা নয়। কিন্তু বদলের ভাবনা৷ বিদ্যমান বৈষম্যপূর্ন মনোভঙ্গি বদলের৷ বিনির্মাণের ভাবনা৷ বৈচিত্র্যের পক্ষে ভাবনা। সমতার পক্ষে ভাবনা। একটা কন্যাশিশু ও ছেলেশিশু কিভাবে বিকশিত হয়ে উঠতে পারে পরিণত মানুষ হিসেবে, সংবেদনশীল মানুষ হিসেবে তার নানাবিধ সাবলীল আলোচনা সমৃদ্ধ করতে পারে পাঠককে। নারীর জন্য তো নয়ই এমনকি পুরুষের জন্যও নারীবাদ কোনো প্রত্যাখ্যানের বিষয় নয় বরং সাদরে গ্রহণের– এ বোধ জন্ম নেয়ার সুন্দর একটা সম্ভাবনা হাজির করে বইটি। আরও বিষয় ধরে কথা বলা যায় বইটি ধরে। কিন্তু না, আর নয়। পাঠকের পড়ার জন্য, বিবেচনার জন্য বাকিটা রেখে দেয়াও জরুরি৷ এক বসায় শেষ করা যায় ছোটো কলেবরের এই বইটি৷
সর্বোপরি, খুবই সামান্য কিছু জায়গা ছাড়া বইটির অনুবাদ পড়তে স্বস্তিই লাগে। ছোটো-ছিমছাম ও সুন্দর প্রচ্ছদে ও ছাপানোতে বইটি যথেষ্ট আকৃষ্ট করে। পরীক্ষার হলে কাজ করার একপর্যায়ে বইটি পড়া শুরু করেছিলাম। এক সহকর্মী বইটি নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বলছিলেন, ‘এত সুন্দর, মনে হয়, আদর করে রাখি।’ সহকর্মীর সে স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্যটি একেবারে অমূলক ছিলো না।
সুস্মিতা চক্রবর্তী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগে অধ্যাপনা করেন ।