সুমন সাজ্জাদ
‘‘‘এ্যাই, তুমি হিন্দু, না মুসলমান?’’ কলেজে পড়ার সময় দ্বিতীয় বর্ষের শেষ দিকে আমার এক প্রায়-প্রতিনিয়ত এক-সাথে-চলা বন্ধু জিজ্ঞেস করল। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘‘হঠাৎ এই প্রশ্ন ক্যান?’’ বলল, ‘‘তোমারে হিন্দু মনে হয়।’’
— কী দেখে?
— হিন্দু পাড়ায় থাকো। হিন্দুদের সঙ্গে চলো।
— তাতে সমস্যা কী?
— সমস্যা না, হিন্দু মনে হয়।
— আমার নাম মনে আছে?
— সুমন।
— অফিসিয়ালটা?
— সাজ্জাদুল ইসলাম….
— তাহলে?
— ওহ্। তাই তো!
হুম, কথা সত্য। আমি বড় হয়েছি হিন্দু পাড়ায়। হিন্দুদের সঙ্গে। আমার বেশির ভাগ বাল্যবন্ধু ছিল হিন্দু। আমাদের পাড়ায় তিন ঘর ছিল মুসলমান। এখন অবশ্য জামানা বদল গিয়া।
.
বদলে গেছে ১৯৯২-এর পর থেকেই। অবশ্য রাজনৈতিক ও সাংবিধানিকভাবে বদলের সূচনা আরও আগে। আমার চোখে এই বদলটা ধরা পড়েছে ৯২-তে। হঠাৎ শুনতাম, ‘‘মন্টু ড্রাইভাররা তো নাই, গেছে গা।’’ ‘‘গেছে গা’’ মানে, ‘‘ইন্ডিয়া গেছে গা।’’ ‘‘পালেরা কই? দেহি না যে…’’। ‘‘পালেরাও গেছে গা।”, “ওমা, কবে গেলো!’’ ‘‘সুপ্রীতাদি, ওরা কই?’’, ‘‘ওরাও গেছেগা’’। ক্লাসে গিয়ে শুনি, দেবেশ-পরেশ — দুই ভাইয়ের এক ভাই দেবেশ চলে গেছে। অশোক চলে গেছে। ভালো ছবি আঁকত তপু — চলে গেছে।
.
হঠাৎ। আকস্মিক চলে যেত। পড়ে থাকত শূন্য ভিটাবাড়ি। একদিন নতুন মালিক এসে আসন গাড়ত। উপড়ানো তুলসীতলা। তখন জানতাম, অমুক গেছেগা, তমুক গেছেগা, অমুক থাকব না। একদিন শুনি বিধবা চৌধুরানী বুড়িটাও চলে যাবে। ছেলে থাকত ইন্ডিয়ায়। ব্যাংকে চাকরি করত। স্বামীর ভিটা বলে এ দেশে বুড়ি একাই থাকত। সবাই বলত খুব কিপটা। বুড়ির একটা গরু ছিল। নাম শুক্লা। বুড়ি আর শুক্লার সঙ্গে আমার খুব ভাব ছিল। শুক্লার যখন বাচ্চা হল, বুড়ি কাঁসার গ্লাসে করে আমাকে এক গ্লাস দুধ দিয়েছিল খেতে। আমার মনে হয়েছিল, কই কিপটা না তো!
.
মনীষা কৈরালার মতো দেখতে নেপালি বৌদি, সুমন্তদার বউ; ক্লাস সিক্স-সেভেনে থাকতে যাঁর প্রেমে পড়লাম, সেই বৌদিরাও চলে গেল। একদিন চলে গেল পালেরা। বিরাট এলাকা জুড়ে জায়গাজমির মালিক ছিল মধু পাল। শেষ দিকে উন্মাদ হয়ে গেছিল। গভীর রাতে এ-বাড়ি ও-বাড়ির মানুষদের ডেকে তুলত। নিজের বাড়ি বলে ভুল করত। দলিল খুঁজত। টাকা চাইত। ক্যান চাইত! তাঁর ছেলে মুকুল পাল — নিঃসন্তান। কাকি ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। আর ‘‘হিন্দু সুন্দরী’’ মানেই কখনো কখনো ‘‘আপনা মাংসে হরিণা বৈরী’’। আর তাই অনিরাপদ হয়ে উঠেছিল তাঁদের জীবন। অতএব, ‘‘ইন্ডিয়া গেছে গা।’’
.
মনে পড়ে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর দিন। শহর জুড়ে থমথমে পরিস্থিতি। সন্ধ্যে বেলায় মন্দিরের কালী প্রতিমা ভাঙা হলো। মন্দিরের সামনের শিমুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি প্রতিমা ভাঙা দেখলাম। আম্মা যদিও বলেছিলেন, ‘‘যাইস না, সাক্ষী থাকতে নাই।’’ কিন্তু আমি গেলাম, দেখব বলে। দেখলাম। এখনও দেখতে পাই মাগরিব-উত্তর সেই জেহাদি জোস।
.
আমাদের পাড়ায় তখন ভয় আর আতঙ্কের ছাপ। যাঁর যা সহায় সম্বল, টাকা, পয়সা, গয়না — আম্মার কাছে গচ্ছিত রাখলেন। সেই রাতে মাটিতে বিছানা পেতে ঘুমাল সোমত্ত মেয়েরা। পাণ্ডা টাইপের সন্দেহজনক কয়েক জন আমাদের বাড়িতে এলো : ‘‘আরে ভয় নাই, কিছু অইব না।’’, ‘‘এইডা ক্যাডা, অমুকের বউ না? ওইডা ক্যাডা? তমুকের মাইয়া? বড় হইয়া গেছেগা!’’ তাদের চোখেমুখে জিঘাংসা আর তৃষ্ণার তিমির আমি বুঝতে পেরেছিলাম। মেয়েরা বুঝতে পেরেছিল সব চাইতে বেশি।
.
ধীরে ধীরে বদলে গেলো সব। সেক্যুলার-নন সেক্যুলার প্রতিটি জামানায় আমি দেখেছি আতঙ্কিত চোখ-মুখ। কিন্তুটা এমনটা তো ছিল না। আমাদের পাড়ায় উৎসব বলতেই ছিল দুর্গা পূজা, সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মী পূজা, কালী পূজা। সব পূজাকে ছাপিয়ে যেত দুর্গা পূজা। আলো ঝলমলে রাত। ঢাকের শব্দ। ধূপ-ধুনার মিষ্টি গন্ধ। মাইকে সেই বিখ্যাত গান ‘‘কাইসে বানি, কাইসে বানি’’।
.
একবার ৫৭টা প্রতিমা গড়া হয়েছিল আমাদের ছোট্ট শহর আর শহরতলিতে। বন্ধুদের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকত কে কয়টা প্রতিমা দেখল! রাতের অন্ধকারে বন্ধুরা মিলে দূরের গ্রামেও চলে যেতাম প্রতিমা দেখতে। কখনও কখনও পূজায় ব্যবহৃত হত আমাদের বিদ্যুতের লাইন, জায়গা, বেড়া, টিন। সহায়ক মনে করলে পূজা-কমিটি চাইত। আব্বাকে কখনো নারাজি হতে দেখি নি। আব্বা যদিও মোটামুটিভাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। সকালে কোরআন পড়তেন। সার্বজনীন পূজা কমিটিতে সম্মান করে আব্বার নামও লেখা হত কখনো কখনো।
পূজার কয়েকটা দিন আমাদের বাড়িতে গ্রাম থেকে প্রচুর মেহমান আসত। শহরের দিকে ছুটে আসত শত শত মানুষ। সিনেমা হলগুলো তখন সরগরম — ‘‘আলোমতি প্রেমকুমার’’, ‘‘নাগনাগিনীর প্রেম’’। ঘোষপট্টিতে উড়ে বেড়াত গরম জিলাপি, আমিত্তি, ছানার পায়েস আর ছানার পোলাওয়ের জিভে পানি আসা গন্ধ।
.
বিসর্জনের দিন ছিল একদম উল্টো। মন খারাপের দিন। সকাল থেকেই ভাঙাপূজার সুর। পুরো পাড়ায় নেমে আসত ‘‘মা চলে যাওয়া’’র গভীর করুণ বিষাদ। সুনসান নীরবতা। সন্ধেবেলায় মন খারাপ করে বসে থাকতাম।
.
বহু বছর হিন্দু-অধ্যুষিত পাড়ায় থাকলাম; ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কখনো ভেতর বা বাহির থেকে মানসিক ‘‘দূরত্ব’’, ‘‘ভেদ’’ বা ‘‘বিচ্ছেদ’’ বোধ করি নি। আমার মনে হয়, ধর্মবিশ্বাস, ধর্মকেন্দ্রিক কৃত্য বা রিচুয়াল এবং ধর্মকেন্দ্রিক সংস্কৃতি সব সময় শক্ত বাঁধনে আটকে থাকে না। তাই বোধ হয়, ধর্মকেন্দ্রিক ‘‘উৎসব’’কে ধর্মকেন্দ্রিক ‘‘সংস্কৃতি’’র একটি প্রকাশ হিসেবে দেখতে পাই; বিশ্বাসকেন্দ্রিক ‘‘কৃত্য’’ বা ‘‘রিচুয়াল’’টুকু বাদ দিলে ‘‘ধর্মবিশ্বাসে’’র সঙ্গে ‘‘উৎসবে’’র আপরাপর অংশের (খাওয়া, দাওয়া, বেড়ানো, আড্ডা দেয়া ইত্যাদি) কোনো আঙ্গাঙ্গী, অনিবার্য বা আবশ্যিক সম্পর্ক নেই বলেই মনে হয়। যদি শক্ত বাঁধনে আটকাই থাকত, তাহলে কেউ কারো ‘‘উৎসবে’’ শরিক হতে পারত না। ‘‘উৎসবে’’ অংশ নেয়ার অর্থ ধর্মের আবশ্যিক ‘‘রিচুয়াল’’ বা ‘‘কৃত্যে’’ অংশ নেয়া নয়।
.
মজার ব্যাপার, আমাদের পাড়াটা আসলে বহুসংস্কৃতি ও বহু ধর্মের সহাবস্থানময় এলাকা; এখানে আছে বাঙালি, গারো, হদি; আছে হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিস্টান! দুর্গাপূজাকেন্দ্রিক উৎসবটাকে কম-বেশি সবাই উপভোগ করত। এখনকার অবস্থা কেমন বলা মুশকিল; কারণ আমার সেই বাগবাড়ীতে আমি নিজেই আউটসাইডার ও এলিয়েন হয়ে পড়েছি।
.
কতো দিন পাড়ার সেই উৎসব দেখি না। বন্ধুরা কে-কোথায়-কেমন আছে, ঠিকমতো জানি না। এবারও পূজাটাকে মনে পড়ছে। মনে পড়ছে প্রতিমার মুখ। তাঁর চেয়ে এবং তাঁর মতো সুন্দর ও মায়াময় নারী পৃথিবীতে আমি আর কখনো দেখি নি, নিশ্চিত দেখবো না। যাবো যাবো করতে করতে হয়তো এবারও যাওয়া হবে না। মাঝে মাঝেই দুষ্টুমি করে বলি, ‘‘শিক্ষিত চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত আসলে বাড়ি ফেরে লাশ হয়ে; তার আগ পর্যন্ত শহুরে মধ্যবিত্তের সকলই নস্টালজিয়া।’’ সম্ভবত আমিও নস্টালজিয়ায় ভুগছি। তবু সবার জন্য শারদীয় শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা!’ [কয়েক বছর আগে লিখেছিলাম… আজও ভাবছিলাম। আবার দিলাম…]
সুমন সাজ্জাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।