মঈন জালাল চৌধুরী

আমি যখন এই পোষ্টটি নিয়ে আমার মন্তব্য/বিশ্লেষণ লিখছি ততক্ষণে পোষ্টটির বয়স ২৩ ঘন্টা। পোষ্টটিতে ৩৪টি কমেন্ট পড়েছে। দুইবার শেয়ার হয়েছে। এই পোষ্টটিতে হাহা রিএ্যাক্ট হয়েছে ৬৩টি, লাইক হয়েছে ২৩টি, বেদনা দেখিয়েছেন ৩জন, লাভ রিএ্যাক্ট দিয়েছেন ২জন, বিস্ময় ১ জন। সময় এবং পরিসংখ্যান খুব গুরুত্বপূর্ণ।

“New appointments and positions are great. But is it necessary to upload the screenshot of appointment letters on Facebook just to join a new organization?”

উনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাম্প্রতিক একটি প্রবণতা পর্যবেক্ষণ করেছেন যার আমার মত করে অনুবাদ করলে দাঁড়ায়ঃ “চাকুরীতে নতুন যোগদান এবং পদায়নের বিষয়টি দারুণ। যদিও ফেইসবুকে নিয়োগপত্রের স্ক্রীণশট আপলোড করা কি আবশ্যক; কেবল/তাও আবার একটি নতুন প্রতিষ্ঠানে যোগদানের জন্য?” (এই অনুবাদ আমার নিজস্ব, শব্দ ও বাক্যের ভিন্ন ভিন্ন আর কি কি অর্থ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন মুখোমুখি আলাপচারিতায় তা হয়ত আরো পরিষ্কার হবে, সেই সম্ভাবনার প্রত্যাশা রইল; আপাতত টেক্সট নিয়ে কথা বলি)।

দুই বাক্যের দ্বিতীয় অংশের দুটি শব্দ/শব্দগুচ্ছো গুরুত্বপূর্ণ “necessary” এবং “just to join”। তিনি সম্ভবত কোন প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে (Formal) যুক্ত হবার বিষয়টির সাথে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আনুগত্য/ল্যয়ালিটি প্রদর্শন এবং উদযাপণের বিষয়টি নিয়ে ক্রিটিক করেছেন। (আরেকভাবে দেখলে একটু খোঁচাও দেবার চেষ্টা করেছেন।) অর্থনির্দেশ (ডিনোটেশন) এবং অর্থ/অভিপ্রায় হিসেবে (কনোটেশন) বোঝাটা কার্যকর।

অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে তিনি হয়ত আমাদের বাস্তব/ফিজিক্যাল/অফলাইন জগতের কর্মকান্ডের ভার্চুয়াল/অনলাইন পরিবেশন নিয়েই হয়ত কথা বলছেন। তবে আমার পাঠ বলে যে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আচরণ নিয়েই কথা বলছেন। যদিও তা মোটেও অফলাইন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়।

 

Screen shot from Mahmudul Sumon’s facebook page, reproduced with permission.

সাইডটক ১

আরো বহু পাঠকের মত অনেক স্কলারই অফলাইনের ভর দ্বারা আক্রান্ত হন। মানে তাঁদের চিন্তায় অফলাইনের বাস্তবতাই বাস্তব, সেটার যে সুত্রসমূহ, প্যাটার্ণ সেটা এসেনশিয়াল বাস্তবতা হিসেবে হাজির হয়, সেই চোখ দিয়ে তাঁরা জগৎ-কে, ব্যক্তিকে এমনকি গোত্রকে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন। আবার উল্টোভাবে যারা অনলাইনে ডুবে থাকেন তাঁরাও একই প্রবণতায় আক্রান্ত হন এমনও দেখেছি। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমের কালে নৃবিজ্ঞানীদের জন্য, “আমি” এবং “অপরের” যে বিতর্ক তা আবারো নতুনভাবে হাজির হয়েছে বলেই মনে করি। নৃবিজ্ঞানীদের একটু মনে করিয়ে দেই এই যেমন এক দল নৃবিজ্ঞানী ইউরোপের চোখে বাকীদের দেখতে চেয়েছেন আবার তখনি ক্রিটিক এসেছে কোন ঐতিহাসিক নির্দিষ্ট “সংস্কৃতি”-র মানুষকে তাঁদের চোখ দিয়েই দেখতে হবে। এজন্যই তো এথনোগ্রাফী। আর ট্রান্সলেশন নিয়ে এত তর্ক (আদৌ ট্রান্সলেশন সম্ভব? কতটুকু? কীভাবে?)

নৃবিজ্ঞানীদের জন্য তাই অত্যন্ত আগ্রহ জাগানীয়া ক্ষেত্র হল এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমি দীর্ঘদিন ধরে বিশ্লেষণ করে আসছি যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে দেখতে হবে সমাজ হিসেবে, সামাজিকতা হিসেবে। এটিকে কেবল যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করার দিন শেষ!

কেবল যোগাযোগ মাধ্যম নয় হাইব্রিড সমাজ

আর এখান থেকেই আমার উত্তর প্রচেষ্টা। আমি আমার গবেষণাতে দেখিয়েছি যে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং অফলাইন সমাজ সবসময়ই একটি গতিশীল জটিল সম্পর্কে থাকেন। সেই অর্থে অন্তত নিরাপদভাবে এতটুকু দাবী করা যায় যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাপণ করা নাগরিক সমাজ আসলে অনলাইন এবং অফলাইনের মিলিত হাইব্রিড সমাজ। আর সেই সমাজেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি কম্পোনেন্ট (ফেইসবুক স্ট্যাটাস, স্ট্যটাসের কম্পোনেন্ট) নিয়ে এখানে কথা বলার চেষ্টা করছি। এখানেও আমি ব্যবহার করছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কারণ এই হাইব্রিড সমাজের এটি যেমন একটি কম্পোনেন্ট তেমনি এটি আবার সমাজও। আর এখানেই ধন্দ্বে পড়ে যান অনেকে। যোগাযোগ মাধ্যমই সমাজ? অনেকেই মানতে পারেন না বিষয়টা।

হাইব্রিড সমাজের কর্মকান্ড

এবার আসা যাক হাইব্রিড সমাজের কর্মকান্ড নিয়ে। মানে সেই ফেইসবুক স্ট্যটাস নিয়ে। নৃবিজ্ঞানী মাহমুদুল সুমনের প্রশ্ন নিয়ে। শুরু করছি বর্দুর সোশ্যাল ক্যাপিটালের সংজ্ঞা নিয়ে। বর্দুর সোশ্যাল ক্যাপিটাল বলতে বুঝিয়েছেন, “Social capital is the sum of the resources, actual or virtual, that accrue to an individual or a group by virtue of possessing a durable network of more or less institutionalized relationships of mutual acquaintance and recognition.”

অনলাইন অংশ

এবার “by virtue of possessing a durable network” নিয়ে যদি কথা বলি তাহলে মোটামুটি দিনের আলোর মত পরিষ্কার যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইন্টারনেট এবং অনলাইনে যোগাযোগের উপর ভর করে এখন একটি ডমিনেটিং “নেটওয়ার্ক”। কতটা durable network সেটা নিয়ে তর্ক থাকলেও, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে durable এর পূর্বতন ধারণাকে সে নানাভাবে পাল্টে দিয়েছে। যেমন: আগে আপনারা পরিচিত দোকানদারের কাছ থেকেই জিনিস কিনতেন, বিশ্বাস করতেন, নিয়মিত কথা হতো, বছরের পর বছর ধরে সম্পর্ক থাকতো এখনো আছে। খেয়াল করেছেন কি আমরা এখন আমাজনের উপর সেই একই বিশ্বাস রাখি, কখনো বেশিই রাখি। দোকানদার চিনেন না, কখনো সামনাসামনি কথা হয়নি যদিও হর হামেশা তার কাছ থেকেই আপনি কেনাকাটা করছেন, রিভিউ দিচ্ছেন। দুটোর আবেদন ভিন্ন, কৌশল ভিন্ন কিন্তু খেয়াল করেছেন কি যে আমাজন কিন্তু আপনার কাছ থেকে বিশ্বাসের সম্পর্ক আদায় করে নিয়েছে। আপনার সম্পদ, অর্থের বিনিময় ঘটছে।

এবার আসি “more or less institutionalized relationships of mutual acquaintance and recognition.” অংশটুকু নিয়ে। খেয়াল করে দেখবেন যে ২০০৭-০৮ এর দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে “কাজ” “JOB” করাকে বাংলাদেশের সমাজে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হোতনা। বলা হোত “ও আপনারা সাংবাদিক মনে হয়”। এই প্রবণতা এখনো ডমিনেন্ট তবে খেয়াল করে দেখুন  যে ই-কমার্স, ডিজিটালাইজেশনের ফলে অফ লাইনে কত রকমের  সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভিত্তিক “পদ” সৃষ্টি হয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজার, এসইও স্পেশালিস্ট, ডিজিটাল মার্কেটার, কন্টেট রাইটার এবং আরো। গুগলে জব পাওয়াকে দেশের প্রধান পত্রিকায় ছাপানো হয়। ফলে ইনফর্মাল থেকে ফর্মাল ইকোনমির দিকে এবং সেই সাথে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার দিকে সেটা ধাবিত হচ্ছে।

হাইব্রিড সমাজের ইনিস্টিটুশনালাইজড নিয়ন্ত্রণ/গাইডলাইন

খেয়াল করেছেন কিনা এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথম যে বিষয়টি ইনিস্টিটুশনালাইজড হয়েছে তার প্রথমেই আছে ডিজিটাল আইন। সেই ২০০৬ সাল থেকে। ফলে কেন্দ্রীয়ভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রথম থেকেই ছিল। ড্রাকোনিয়ান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এর প্রসঙ্গে এখানে খুব বেশি কিছু বলবো না তবে মনে করিয়ে দেবো যে এটি কেবল যোগাযোগকে নিয়ন্ত্রণ করেনি বরং সামাজিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এই হাইব্রিড সমাজে বসবাসকারী মানুষজনকে অত্যন্ত ক্ষতিকারকভাবে প্রভাবিত করেছে। খেয়াল করে দেখবেন এই আইন এবং এর পূর্বসূরী আইনসমূহকে ব্যবহার করে কত ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। আমি মনে করি রাষ্ট্রীয় এই আইন দ্বারা উৎসাহিত হয়ে/আতংকিত হয়ে বিভিন্ন সরকারী এবং বেসরকারী প্রতিষ্ঠান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আচরণবিধি তৈরি করেছেন। দেড় দু বছর আগে হাইব্রিড সমাজের বহুল প্রচলিত কথা, “বললে চাকরী থাকবেনা” তাই কেবলই অনলাইন ট্রল নয়। যদিও জনপ্রিয় ধারণায় অনলাইনকে অগুরুত্বপূর্ণ, কম প্রভাবশালী মনে করার তাগিদে অনেকেই এভাবে দেখে থাকতে পারেন।

হাইব্রিড সমাজে নিওলিবারেল এন্টারপ্রেনারশিপ, ঘোষণা এবং উদযাপণ

তাহলে সহজেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে এখন কি নানান প্রতিষ্ঠানগুলো “ইনফর্মালি” তার এম্প্লয়িদের তাগিদ দিতে থাকে সোশ্যাল মিডিয়াতে বিশেষ আচরণের জন্য? একটু অফলাইনের কথা যদি ভাবি। খেয়াল করে দেখবেন ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের ইন্টারনাল যোগাযোগে বিশেষ ধরনের আচরণ করতে উৎসাহিত করে এবং বিশেষ আচরণ করতে নিরুৎসাহিত করে। আর সবক্ষেত্রেই এম্প্লয়িরা যে সেটা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেন তা নয়। এটি একটি ধারাবাহিক কন্টেসটেশন আর নেগোসিয়েশনের বিষয়। কে কোথায় কোন পদে কাজ করছেন সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউজারকে যেমন প্রজিউমারে রুপান্তরিত করেছে তেমনি তাঁর জন্য নানান ভূমিকায় অবতীর্ণ হবার রাস্তাও খুলে দিয়েছে। তবে সেই রাস্তা আসলে কতটুকু খোলা সেটা নিয়েই আজকের আলাপ। কারণ ব্যক্তি কতটুকু তার ইচ্ছামাফিক ব্যক্তি এবং কতটুকু মতাদর্শ, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আবেশে আছেন সেটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। ফলে নিওলিবারেল এন্টারপ্রেনারশিপ-কে বুঝতে পারা দরকার।

যেমনঃ “আপনি হতে পারেন যা খুশি অবারিত সম্ভাবনা।“ এটি একটি ঘোলা কথা এর মধ্যে অনেকগুলো স্তর রয়েছে। আর অবশ্যই আমাদের মনে রাখতে হবে যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তৈরি করা হয়েছিল নিওলিবারেল তাড়ণা থেকে। মানে ইন্টারেনেট ভিত্তিক ব্যবসা যাতে টিকে যায়। কিন্তু নিওলিবারেল তো কেবল অনলাইনের বিষয় নয় এটি ভীষণভাবে অফলাইনের। বড় বড় এবং সূক্ষ সূক্ষ পরিবর্তনের কারিগর। যেখানে মনে হয় যে আমি বা আমরা তো স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, স্বাধীনতা বাড়ছে, সব গ্লোবাল হচ্ছে, লোকালাইজ হচ্ছে, প্রাইভেট এন্টারপ্রেণারশিপ বাড়ছে কিন্তু আদতে সেটা কেমন সেটাকে নিবিড় অধ্যয়ণ ছাড়া বোঝা অসম্ভব।

আমার হাইব্রিড সমাজে-র হাইপোথিসিসটা তাই হয়ত জরুরী। আপনি এমন একটি সমাজের বাসিন্দা যেখানে জীবনের, চাকুরীর, মৌল চাহিদার নিশ্চয়তা নেই, নিরাপত্তা নেই সেখানে নিওলিবারেল এন্টারপ্রেনারশিপ-বিকশিত হবার কথা। সেটা হবে অবশ্যই স্থানীয় পরিপ্রেক্ষিত, রাজনীতি এবং রিজিওনাল-গ্লোবাল প্রভাবের মধ্য দিয়ে। কোভিডের সময়ে যেখানে চাকুরীর বাজার মন্দা, অনিশ্চয়তা সেখানে চাকুরী প্রাপ্তীর উদযাপণ ও ঘোষনা কি স্বাভাবিক নয়? আবার যদি পোষ্টে সাদেকা হালিমের কমেন্ট “Really embarrassing! However these days shamelessly appointment letters are exhibited. It actually reflects the kind of culture we live in.” হাজির করি তাহলে বুঝতে পারি যে, অফলাইনের ট্র্যাডিশনাল যে সংস্কৃতি ছিল তার বদলে নতুন সংস্কৃতি হাজির হয়েছে। সেটা দুই বলয়ের মিশেল (অনলাইন এবং অফলাইন)।

যে সমাজের প্রথম প্রশ্ন থাকে “আপনি কি করেন?” সেই সমাজে চাকুরীর মাধ্যমে মর্যাদা লাভের এবং তৎ-পরবর্তী ক্ষমতার উদযাপণ কল্পনাযোগ্য। বিসিএস এ কৃতকার্য হওয়া নিয়ে উচ্ছাস খেয়াল করুন। আবার একইসাথে, যেখানে ফ্রিল্যান্সার আত্মহত্যা করার আগে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দেন তাঁর পরিবারকে দেখে শুনে রাখার অনুরোধ জানিয়ে। কৃষক আত্মহত্যা করেন আর তাঁর মৃত্যুর খবর আমরা জানতে পারিনা কারণ তিনি ফেইসবুক ব্যবহার করতেন না বলে। আসলে হাইব্রিড সমাজের দুই বলয়েই (অনলাইন-অফলাইন) তিনি ভীষণ প্রান্তিক বলে। সেই সমাজে সোশ্যাল মিডিয়া যারা সুবিধাপ্রাপ্ত তাদের সুবিধা বৃদ্ধির একটি জায়গা হিসেবেই বিকশিত হবে।

আবার যে সমাজে “আনুগত্য” মোটামুটি টিকে থাকার একমাত্র পথ, সেখানে কি বাড়তি চাপ আসবে না, ব্যক্তির এই লোকালাইজড নিওলিবারেল এন্টারপ্রেনারশিপ কি বারবার তাঁর প্রতিষ্ঠান না চাইলেও, ইঙ্গিত না দিলেও সপ্রমাণ হাজির হবার তাড়ণা বোধ করবে না? এই যে হাইব্রিড সমাজে-র চাপ যা তাকে সারাক্ষণ প্রশ্ন করছে-আপনি কি করেন?

নিজের টিকে থাকা, ক্ষমতা সম্প্রসারিত করা, সোশ্যাল ক্যাপিটাল বাড়াতে থাকা এবং ইকোনোমিক পাওয়ারে কনভার্ট করার তাগিদ এবং চাপের জন্যই হয়ত; যেই অফলাইন-অনলাইন হাইব্রীড সমাজে “প্রাইভেসি”, “ভোক্তার অধিকার”, “নাগরিক অধিকার”, “স্বাভাবিক মৃত্যু” অধিকাংশ সময়ে বাহাস সেখানে এক বিশেষ ধরনের বিবেচনা বোধ; যা ইঙ্গিত করা হয়েছে এই পোষ্টে তা আর হয়ত কাজ করেনা। করলেও আগের মত করেনা। তার ধরন পাল্টে যাচ্ছে।

নিউলিবারেল এন্টারপ্রেনারশিপ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেল্ফ প্রজেকশন

অন্যদিকে আরেকভাবে যদি দেখি তাহলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেল্ফ প্রোমোশন এবং প্রজেকশন একইসাথে হাইব্রিড সমাজে টিকে থাকা এবং কেউকেটা হবার একটি রাস্তা। আগের অংশে ব্যক্তির এজেন্সী নিয়ে যেমন আলোচনা শুরু হল সেটিকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে বলি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কি সবাইকে মাইন্ডলেস সেল্ফপ্রমোটারে পরিণত করে? আমার উত্তর হল না। পোষ্টটির কমেন্ট সেকশন ঘুরে আসলে অনেকগুলো ক্লু পাওয়া যেতে পারে। যেমন Mahajabin Khan মনে করেন যে এটি কেবলই Show Off হতে পারে। আবার Aanmona Priyadarshini মনে করেন যে “নিজের ঢোল পেটানো হয়তো জরুরী। কিন্তু কতো সৃষ্টিশীলভাবে তা পেটানো যায় সে বিষয়ে পদ্ধতিগত (methodology) দিকে আরও মনোযোগ দেয়া দরকার নৃবিজ্ঞানীদের।“

আমি মনে করি যে এটি একইসাথে অটোমেটেড এবং গোছানো একটি প্রসেস (মানে ব্যক্তির হাত আছে)। হাইব্রিড সমাজে-আমরা বসবাস করলেও আমাদের এই যোগাযোগের, সম্ভাবনা দেখবার, ব্যবহার করবার, এবং যাপণ করবার ক্ষমতা একই রকম নয়। আবার এই সমাজের নিজস্ব বিচার বিবেচনা, গ্রহণ-যোগ্যতা ইত্যাদির নানান রকম পরিমাপ আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে যা গ্রহণযোগ্য তা অন্য প্ররিপ্রেক্ষিতে গ্রহণযোগ্য নয়। গ্রহণযোগ্যতাও খুব ডায়নামিক।

এখানে ব্যক্তি যেমন আছে আবার কালেকটিভও আছে। যেমন এই পোস্টে যারা হাহা রিএ্যাক্ট দিয়েছেন (৬৩টি), তারা যেমন পরিস্থিতি নিয়ে কৌতুক যেমন বোধ করছেন তেমনি স্যাটায়ারও বোধ করে থাকতে পারেন। যারা লাইক দিয়েছেন (২৩টি) তারা নানান কারণেই দিয়ে থাকতে পারেন। পরিস্থিতি নিয়ে বেদনা বোধ করেছেন ৩জন। বক্তব্য নিয়ে লাভ রিএ্যাক্ট দিয়েছেন ২জন, বিস্ময় ১ জন। তবে আদতে তাঁরা কি বোধ করেছেন সেটার জন্য কিছুটা কথা তাঁদের সাথে সরাসরি; বলাটা খুব দরকার হবে।

Aanmona Priyadarshiniএর কমেন্টের “সৃষ্টিশীল অংশটাকে” বুঝতে পারা গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে এটি যেমন স্যাটায়রিকাল তেমনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অডিয়েন্স আকর্ষণের জন্য “মানুষের সৃষ্টিশীলতার” উপর জোর দেয়। তবে সেটা যতটা অর্থনৈতিক লাভালাভ অর্থে ততটা মানবিক উৎকর্ষতা হিসেবে নয়। আবার কোন একটি সৃষ্টিশীলতার যদি বাজার বৃদ্ধি পায় সে ততক্ষণাৎ সেটিকে কপি করে। আর তার (সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের) ডিজাইনের সাথে অর্ন্তভূক্ত করে। এজন্যই “But is it necessary to upload the screenshot of appointment letters on Facebook” কখনো কখনো কেবল শো অফ নয় একই সাথে অটোমেটেড প্রসেসের শিকার হওয়াও। এই যে মাইন্ডলেস রেপ্লিকাবিলিটি সেটি নিওলিবারেল এন্টারপ্রেনারশিপ ও সেল্ফ প্রজেকশনকে একটি ম্যানুফেকচারড আউটকাম হিসেবেই হাজির করে। আবার একইসাথে মাইন্ডফুলভাবে আরো সৃষ্টিশীল হিসেবে হাজির হওয়াকেও উৎসাহিত করে।

ফলে আমি মনে করি যে পোস্টদাতা আসলে যেই প্রশ্নের দিকে ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন তা হল কোন ধরণের “সেল্ফ” এ রূপান্তরিত হচ্ছি আমরা। আমি মনে করি “সেল্ফ” এবং “কালেকটিভ” হিসেবে নিজেদেরকে নানান লেন্স দিয়ে দেখতে পারাটা জরুরি। কিন্তু পোষ্টদাতা সেই বিবেচনাবোধের ইঙ্গিত করেছেন তা আমার মতে একটা অটোমেটেড রিপ্রোডাকশন যেমন তেমনি কোথাও না কোথাও নেগোসিয়েশন বা খুব হতাশাবাদী শোনালে নেগোসিয়েশন প্রচেষ্টা। বিশেষত বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে।

Photo source: author

মঈন জালাল চৌধুরী সহকারী অধ্যাপক,  ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। পি এই চ ডি ও পোস্ট ডক করেছেন জাপানের হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

 

0 Shares

Leave A Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 + 18 =