তাসমিয়া আফরিন মৌ
যে নিজেকে পাবলিক করে দেয় প্রতিটি ক্ষেত্রে, তার মত বিজ্ঞাপিত জিনিষ আর কি আছে? ফলে বিজ্ঞাপনের মত তার নিজেকেও মিথ্যা দিয়ে ফুলিয়ে ফাপিয়ে বাড়াতে হয়। নিজের ভাষা, ইমোশন ও সেক্চুয়ালিটি বিক্রয়যোগ্য করতে হয়। এসবে যা নাই- তা আরোপ করতে হয়। এমন কি খুবই বৈপরিত্যময় ‘নিষ্পাপ’, ‘আদুরে’, ‘দায়িত্ববান’ ইত্যাদি সমাজস্বীকৃত মিঠা মিঠা পরিচয়েও চেহারা বানাতে হয়। ফলে এই আধুনিক ব্যক্তিবর্গ নিজেরাই নিজেদের পণ্য বানায়ে ‘ওয়াও’, ‘দারুণ’, তোমায় খুব হিংসা’ ইত্যাদি কথা শুনে আপ্লুত হচ্ছে। অথচ সে নিজেও জানে এগুলো মিথ্যা, ফাটা, ফাঁপা। সোশাল মিডিয়ায় প্রাইভেট সকল কিছু পাবলিক করে দেবার বিষয় নিয়ে আগে কথা বলেছি কয়েকবারই। কিন্তু এর সাথে বিজ্ঞাপন শব্দটার সম্পর্ক নিয়ে ভাবছি অল্প ক’দিন।
চলচ্চিত্র নির্মাতা নূরুল আলম আতিক বলছিলেন, “কিছুদিন পর স্যোশাল মিডিয়ায় প্রত্যেকেই কনজুমার এবং প্রডাক্ট হয়ে উঠবে। যার ইশারা অলরেডি দৃশ্যমান। ইনডিভিজ্যুয়াল ব্যক্তি বিজ্ঞাপন দিবে এবং অপর ইনডিভিজ্যুয়াল ক্রয় করবে। এভাবে সকলেই পণ্য ও ক্রেতা হয়ে উঠবে। তখন আর আলাদা করে কোম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন বানানোর প্রয়োজন ফুড়াবে। যেমন কফিশপে বা কোনো ব্র্যান্ডের দোকানে চেকইন দেয়া, এই প্রডাক্টটি সে কিনেছে – প্রডাক্টটির সাথে সেলফি দেয়া, অমুক হোটেলে আর বিচে সে বেড়াচ্ছে – তা কত ভালো বলে রেটিং দেয়া ইত্যাদি।”
কিন্তু এসব সে কেনো দেয়? কারণ এর সাথে সোসাইটি নির্ধারিত ‘স্ট্যাটাস’ বাড়ার একটা বিষয় থাকে। যেহেতু আপনি কত বড় কনজুমার তার সাথে আপনার সামাজিক মর্যাদা নির্ভর করে। আপনি আপনার মত কনজুমারদের হিংসার পাত্র হন, কারণ আপনি তা হতে পছন্দ করেন বৈকি!
এই সোসাইটির সমালোচনা যতই করেন না কেনো আপনিই তো একে এভাবেই বজায় রেখেছেন। এভাবে বজায় রাখলে আপনার সুবিধাদি নিতে সুবিধা হয়। প্রথম প্যারায় ফেরত যাই। সরাসরি পণ্যের বাইরে নিজেকে পণ্য করে তোলার কারণটা কী আসলে? নিয়মিত পারসোনাল বিষয়, পাবলিক বিজ্ঞাপন আকারে হাজির হচ্ছে কেনো? এসব চোখে নতুন করে ধরা পড়ছে এমন নয়, তারপরও প্রশ্ন তুলছি। কারণ এই আচরণের অর্থ বা ব্যাখ্যা পরিস্কার হয়নি এখোনো আমার কাছে। নিজের অতি ব্যক্তিগত ইমোশন বা ঘটনাবলী মানুষ পাবলিকলি প্রচার করে কেনো? প্রচারের সময় তা বিজ্ঞাপনের মত বাড়িয়ে তোলে কেনো? ভাষা, সেক্চুয়ালিটি ও ইমোশনকে পণ্যের বিজ্ঞাপনের মত বিক্রি করে কেনো? কোথাও দু’চামচ বেশি আর কোথাও এক চামচ কম আবেগ ঢালে কেনো? এই যে নিজের সাথে প্রতারণামূলক আচরণ-তা সে কেনো করে? কার জন্য করে? কোন দর্শককে দেখায়? এই দর্শকরা তো তার কাছ থেকে কিছু কিনবে না। তবে তাকে একটা মার্ক দিবে অবশ্য। এই মার্কিং নিয়ে সে কী করবে? কোন পরীক্ষায় উতরাবে?
নাকি সে বিকারগ্রস্ত? বিকার প্রদর্শনপূর্বক সুখ খুঁজে পায়। প্রতিযোগীতায় এগিয়ে থেকে জেতার শিরশিরানী অনুভব করে। তার কাছে প্রেম এবং অপরাপর রক্ত সম্পর্ক দাড়িপাল্লায় মাপার জন্য এক-একটি বড় বিক্রয়যোগ্য উপাদান হয়ে ওঠে! রাজমুকুট পড়বার প্রত্যাশা তাকে বন্ধুদের মধ্যেও প্রতিযোগী করে তোলে। হায় সুখ! সোনালী ডানায় রোদ মেখে সে যে কোথায় উড়ে গেছে! তার জন্য তার সময় নাই।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘পারসোনাল বিজ্ঞাপন’ প্রচারে কোম্পানির প্রচারিত বিজ্ঞাপনগুলোর প্রভাব তো নিশ্চই আছে। ৭দিন ২৪ ঘন্টা আমরা বিজ্ঞাপনে বাস করি। টিভি, ফেসবুক, রাস্তার বিলবোর্ড, পত্রিকা এমন কি মানুষের মুখে মুখে বিজ্ঞাপন দেখতে ও শুনতে হয়। খবরের চিপা দিয়েও বিজ্ঞাপন উঁকি দেয়, প্রকটভাবে তাকিয়ে থাকে আপনার জাতীয়তাবাদী প্রিয় খেলোয়ারের জামায়। পানির বোতলে। জনপ্রিয় ডায়ালগে যা সিনেমাতেও পৌঁছে। ধরেন, যে দু’টা বিজ্ঞাপন দেখলে ও শুনলে আমার মাথায় আগুন ধরে যায় সেই একই বিজ্ঞাপন নিশ্চই এই সমাজেরই আমার ক্লাসের ও সময়ের অন্য কাউকে নিজেকে বিজ্ঞাপিত করতে উৎসাহ যোগায়। প্রশ্ন থাকবে, কেনো একই বিজ্ঞাপন একজনকে বিরক্ত করবে অন্যজনকে আবেশিত করবে? কারণ চিন্তায়। চিন্তা করতে চাওয়া বা না চাওয়ায়। কারণ জানেন তো, চিন্তা করতে কষ্ট হয়। চিন্তা করলে অনেক সময় স্বার্থও নষ্ট হয়।
বিজ্ঞাপন দু’টা হলো-
ক) ফেয়ার এন্ড লাভলি ফেসওয়াশ
খ) ক্লিয়ার শ্যাম্পু
ফেয়ার এন্ড লাভলি’র জিঙ্গেলে “ওহ নো! ওহ নো” বলে চামড়া সর্বস্ব মেয়েরা যে গানটা গাইতে থাকে এবং সাদা থেকে ততধিক সাদা হয়ে ওঠা মডেল ইয়াম্মি থুতনি উঁচু করে গর্বিতভঙ্গীতে চলে আসে, সেই ইমেজ আর দেখার দরকার হয় না। এখন কেবল মিউজিক শুনলেই ইমেজ ভেসে ওঠে আর মাথায় হাতুরির বাড়ি পড়তে থাকে। আমার ও এ অঞ্চলের মেয়েদের গায়ের কালো রং নিয়ে ৭দিন ২৪ ঘন্টা অপমানিত হতে থাকি। প্রতিনিয়ত অপমানিত করার সাহস এরা কই পায়? আমাদের কাছেই নিশ্চই। “অনন্যা” পত্রিকা এই “ফেয়ার এন্ড লাভলি অনন্যা পুরস্কার” দেয়। আমাদের ত্যাগী নারীরা আবার সেটা গ্রহণ করেন।
ক্লিয়ার শ্যাম্পু বলে, “আই হ্যাভ নাথিং টু হাইড”। নিশ্চই! এখন আপনি টয়লেট কার্যও সকলের সামনে করেন, কে মানা করেছে? সেজন্যই তো আপনি প্রেম করে তা ভেঙ্গে যাবার পর ইনবক্সের স্কৃনশটের খবর, আবার তার বিপরীতে স্ত্রীর সাথে প্রেম প্রেম ছবি দেবার খবর (রিসেন্টলি নারী রাইটার ভার্সেস পুরুষ ব্যরিস্টারের পারসোনাল বিজ্ঞাপনের কথা বলছি) দিচ্ছেন। অথবা আপনি অনায়াসে নিজের স্মৃতির খবর পাবলিক করে দিচ্ছেন। কারণ এসবই আপনার কাছে বিক্রয়যোগ্য সম্পত্তি, সম্পদ নয়।
বহু গবেষণা করে আপনার চিন্তার উপর আধিপত্য তৈরি করে সবাইকে একমুখী চিন্তা করার জন্য বিজ্ঞাপন তৈরি করা হয়। নইলে সে প্রডাক্ট বেচবে কীভাবে? কিন্তু নিজেকে প্রডাক্ট বানিয়ে তোলার প্রক্রিয়ায় থেকে যারা নিয়মিত পারসোনাল এড বা ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাচ্ছেন, তাদের মোটিভেশন আসলে কী? বিশ্বমঞ্চে তাদের অভিনয় ভালো হচ্ছে। কিন্তু সকলেই তো দর্শক নয়! কেউ কেউ বিচারকও!
কিন্তু তাদের ভরসার জায়গা হলো, বিচারকরা বিচার চলাকালীন কিছু পাবলিক করেন না। সময়মত শুধু রেজাল্ট জানা যায়। প্রতুলের গানটা একটু শুনেন মাঝে মাঝে। তাতে যদি নিচের জীবনে নিজেই মডেল হয়ে, অভিনয় করে, নিজের বেচা বিক্রি একটু কম করেন!
(লেখটি সামাজিক মাধ্যমে প্রথম প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে)
তাসমিয়া আফরিন মৌ চলচ্চিত্র নির্মাতা।
0 Shares

Leave A Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 4 =