আবুল কালাম আজাদ
পুরানো জামা কাপড় গুছাতে গিয়ে একটি বারগান্ডি কালারের ভি গলার উলেন স্যুয়েটারটি হাতে নিলাম। স্মৃতিকাতর হয়ে অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্যুয়েটারটি দেখলাম। সম্ভত আমার বয়স যখন ১১-১২ বছর তখন আমি শীত নিবারণে ব্যবহার করেছিলাম। কী এক মায়া লাগানো আছে এই শীত বস্ত্রটিতে। আমার চেয়ে বয়সে অনকে কম আমার সর্বকনিষ্ঠ বোন তিথিকে আমি এখন থেকে প্রায় ২৪ বছর আগে এটি ব্যবহার করতে উৎসাহিত করেছি। এটাতে ওকে আরও অনকে উজ্জ্বল লাগত। বছর ৪-৫ আগে আমার একমাত্র কন্যা কারিমা সেলিন আজাদকেও শীত বস্ত্রটি পরিধানে উৎসাহ যুগিয়েছি। ওকেও অনেক মানিয়েছিল।
শীতের প্রাক্কালে অ্যালেনকে অব্যবহৃত শীতবস্ত্র শীতার্তদের বিলিয়ে দিতে পরামর্শ দেই। আমার বিশ্বাস যা গত ১-২ বছর আমাদের ব্যবহার করতে হয়নি – তা আমাদের জন্য অতিরিক্ত এবং অপ্রয়োজনীয়। বরং তা যাঁর প্রয়োজন তাঁকে দিলে বস্তটির সদব্যবহার হবে এবং সৃষ্টিকর্তাও খুশী হবে। এ ভাবনাকে একটি জীবনদর্শন হিসেবে নেওয়া সুখকর হতে পারে। আশ্চর্য্য হই, যখন দেখি আমি বছরের পর বছর এই স্যুয়েটারটি হাত ছাড়া করতে চাচ্ছি না। আমারই জীবনদর্শনের সাথে একটা সাংঘর্ষিক প্রপঞ্চ তৈরি করেছি। এখন থেকে প্রায় ৪৩ বছর আগে আমার সেজ ফুপু (মোসাম্মৎ সামছুন্নাহার) নিজ হাতে স্যুয়েটারটি প্রকৃত উলেন ও লম্বা লম্বা কাটা ব্যবহার করে বুনন করেছেন। আমরা তাঁকে মতি ফুপু ডাকতাম। আমারা পাঁচ ফুপুর মধ্যে তিনি ছিলেন একেবারেই আলাদা। মিষ্টি কিন্তু হালকা রং এর কাপড় পরতেন। খুব সাধারণ সাজের মধ্যে একটা আভিজাত্য ও শুভ্রতার ছোঁয়া ছিল। সিংগার সেলাই মেশিন দিয়ে যেমনি নিজের ছেলে-মেয়েদের জন্য তেমনি প্রয়োজন বুঝে ভাতিজা-ভাতিজিদের জন্য খুব যত্ন করে জামা – কাপড় বানাতেন। ডিজাইনে অনেক আধুনিকতা ও পারফেকশন ছিল। আতিথেয়তা ও রন্ধনশৈলীতে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। কাজী সাহেদ দুলাভাইয়ের (ফুপুর বড় মেয়ে বেবি আপার স্বামী) মুখে আমি অনেকবার শুনেছি , “ আম্মার মত করে এত সুস্বাদু মাংস, পোলাও কোথাও কেউ পাক করে খাওয়াতে পারেনি। একবার যে খেয়েছে সে তাঁর পাকানো মশুরের ডালের ঘ্রাণ ও স্বাদ কখনো ভুলতে পারবে না”। ঘরটা সবসময় পরিপাটি করে রাখতেন। সর্বত্রই তাঁর একটা মায়ার ছোঁয়া ছিল, অকৃত্তিমতা ছিল। তাঁর চেহারা, মুখচ্ছবিতে একটা স্নিগ্ধতা, প্রশান্তি, ভালবাসার প্রকাশ, পবিত্রতা লেগে থাকত। তাঁর শাসনেও একটা পরিমিতিবোধ ছিল এবং স্নেহমাখা পরশ লেগে থাকত।
আমাদের জেনারেশন, তারও আগের জেনারশনে – বস্তুগত ভোগের ক্ষেত্রে একটা দায়িত্ববোধ কাজ করত। ঘন ঘন ফ্যাশন, ডিজাইন, মডেল পরিবর্তন করা হত না। বড় ভাইবোনদের কাপর চোপড়, বই-পুস্তক ছোটরা ব্যবহার করত। চাচাত, ফুফাত, খালাত, মামাত ভাইবোনদের মধ্যে, এমনকি প্রতিবেশীদের মধ্যেও ব্যবহারযোগ্য জিনিষপত্রের ব্যবহার ও পুনঃব্যবহার প্রচলিত ছিল। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (SDG) অর্জনে ব্যবহার, পুনঃব্যবহার, রি-সাইক্লিং, রিভার্স লজিস্টিকস, মাল্টিফাকশনার ডিভাইস, পুনঃনবায়নযোগ্য শক্তি ইত্যাদি ধারণার ওপর অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হয়। বাস্তবতা হলো – এসব ধারণার প্রয়োগ ভোগবাদী দর্শনের প্রভাবে সংকুচিত হয়ে পরেছে। প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর চলছে নির্দয় ভোগ। যাঁরা যত বেশী ভোগ করে এবং নির্দয়ভাবে ভোগ করে তাঁরা (ব্যক্তি/জাতি/ দেশ/মহাদেশ) তত বেশী পরিবেশ ও মানবিক বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। তাঁরাই আবার বিভিন্ন jargon ব্যবহারে বিশেষায়িত পারঙ্গমতা দেখিয়ে সহজ বিষয়কে জটিল করে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সেবা ও সমাধান দেয়।
ফুপা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। প্রতিমাসের দুই তৃতীয়াংশ অতিক্রম করলেই একটা আর্থিক টানাপোড়েন ক্ষীণভাবে প্রকাশ পেত। সৎ অফিসার হিসেবে তার একটা সুনাম ছিল। তিনি যে জেলায় চাকরি করেছেন – নিজ এলাকার (বৃহত্তর বরিশাল) লোকজন/আত্মীয়-স্বজন খুঁজে খুঁজে বের করে পরিচিত হতেন ও দাওয়াত খাওয়াতেন। স্বামীর সততাকে গুরত্বসহকারে মূল্যায়ন করে ফুপু সবকিছুই সামাল দিয়ে ফেলতেন। তাঁকে ঘরের লক্ষ্মী বলা হত। আসলেই একজন লক্ষ্মী ফুপু ছিলেন। অভাব, অভিযোগ, অনুযোগ প্রকাশ তাঁর জীবনাচারে ছিল না। তবে তাঁর অভিমান ও প্রখর আত্মসম্মানবোধ ছিল।
বাবাকে দেখেছি মতি ফুপুকে একটু আলাদা স্নেহের দৃষ্টিতে বিবেচনা করতে। চাচাকেও দেখেছি ফুপুর ক্ষেত্রে একটু যেন নিবিড় সম্মান, আস্থা ও ভালবাসার সম্পর্কে। আমার ফুপা ছুটিতে তাঁর পরিবারের সবাইকে নিয়ে ১৯৭৬-৭৭ সালে শ্বশুর বাড়ি (মুলাদী, বরিশাল) বেড়াতে আসলেন। তাঁর নিজের বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জে। আমার দাদা সরকারি চাকরি থেকে ১৯৭৪ সালে অবসরে গমন করে মুলাদীতে বসবাস করছিলেন। মুলাদী বন্দরের অতি নিকটস্থ বাড়ি হওয়ায় আমার ফুপা বুঝতে পেরেছিলেন সঙ্গদোষে ছোট বয়সেই আমার উচ্ছন্নে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ফুপার কী গোচরীভূত হয়েছিল- তা আমার জানা হয়নি। ফুপা-ফুপু আমাকে উন্নত শিক্ষার পরিবেশ দেওয়া আর উচ্ছ্বন্নে যাওয়া থেকে রক্ষার জন্য খুলনা নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সুবাধে আমি ফুপুর কোমল স্নেহ-ভালবাসার পরশ পেয়েছিলাম। আমার ছোট বয়সে পাওয়া ফুপুর স্নেহের পরশ এখনও আমাকে আবেগতাড়িত করে বেড়ায়।
ফুপার জীবন শুরু হয়েছিল বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (মুলাদী মাহমুদজান মাধ্যমিক বিদ্যালয়) শিক্ষকতা দিয়ে। বেসরকারি শিক্ষকদের দাবি দাওয়া নিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক শাসক আউয়ুব খানের জনসমাবেশে বরিশালের বেলস পার্কে গিয়েছিলেন। আইয়ুব খান কথিত সভায় দাবি উত্থাপনকারীদের সরকারি চাকুরির সর্বনিম্ম ধাপেরও নিচে মর্যাদা দিয়েছিলেন। ফুপা ক্ষোভে দুঃখে চাকরি ত্যাগ করে পুলিশ বিভাগে যোগদান করেছিলেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবনে তিনি স্কুলে যাঁদের গণিত ও ইংরেজি পড়িয়েছেন তাঁদের মধ্যে – বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরসহ বেশ কয়েকজন উর্দ্ধতন সিভিল সার্ভেন্ট রয়েছেন। তিনি সকলের কাছে সামছু স্যার নামে জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন। পুরো নাম এ বি এম সামছুল হক। তিনি পুলিশ বিভাগের একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা হিসেবে অবসরে যান ১৯৯৮/১৯৯৯ সালের দিকে। অবসরে গিয়ে তিনি সাভারেরে একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। ব্যক্তিগত আলাপ-চারিতায় তিনি আমাকে বলেছিলেন- ‘আমার চাকরি জীবন শুরু করেছি শিক্ষকতা দিয়ে। আমি আমার শেষ জীবন কাটাবো শিক্ষকতা পেশায়। পুলিশ বিভাগে চাকরি করেছি অভিমান থেকে, আউয়ূব খানের অপমানজনক মন্তব্য থেকে নিষ্কৃতি খুঁজতে , যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে’। ২০০৩ সালে তিনি পরলোকগমন করেন-সাভারের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাকদের শোকেরে সাগড়ে ভাসিয়ে। ষাটোর্ধ্ব বয়সে তিনি শিশু-কিশোর ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে মাত্র ৩-৪ বছরে কতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন – তা আমাকে বিস্মিত করেছে।
তবে আমার মনে হয়েছে একাধারে একজন জাত শিক্ষক এবং গোয়েন্দা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তার সূক্ষ্ণ বিশ্লেষণ সময়োপযোগী ছিল। ফুপা আমাকে দুষ্ট সঙ্গমুক্ত করতে খুলনায় নিয়ে আসেন, স্কুলে ভর্তি করেন। সম্ভবত তিনি তখন খুলনা জেলার পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত ছিলেন। আমি ফুপুর খুব বেশি সান্নিধ্য পাওয়ার এই ছিল পটভূমি। এই স্যুয়েটারটি ফুপুর তখনকার বানানো। এখনো মনে হয় ছোট ছোট হাত, বুকের ছাতি, কাঁধের মাপ, গলার মাপ নিচ্ছেন ফুপু অনেক যত্ন করে। বানানো শেষ করে অনেক আদর করে পরিয়ে দিলেন, অনেকক্ষণ দেখলেন তার সৃষ্টিতে কোথাও কোন খুঁত আছে কিনা। ফুপু বলেছিলেন, ‘ভাইয়ের ছেলেদের শরীর থেকে ভাইয়ের ঘ্রাণ পাওয়া যায়’। এ কথার গুঢ়ূ অর্থ বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে। ১৯৮৫ সালে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পোস্ট অপারেটিভ ইনফেকশনে ফুপু অনেক অভিমান নিয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। Burgundy Color Woolen Sweater আমি মাঝে মাঝে হাতে নেই আর শেত শুভ্র পবিত্র ফুপুর ঘ্রাণ পাই, তাঁর অস্তিত্ব টের পাই।
[২০২০ সালে দ্বিতীয়বার কোভিড আক্রান্তকালীন আইসোলেশনে থাকার সময়ে লিখেছিলাম কিন্ত পোস্ট করা হয়নি। ল্যাপটপে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ লেখাটি নজরে এল। মনে হল পোস্ট করলে ঐ সময় প্রদত্ত সময়, শ্রম ও চিন্তাসত্ত্ব/মেধাসত্ত্বে কিছুটা হলেও ভ্যালু যোগ হবে।]